ইংল্যান্ডের “দ্যা ওভালে” আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের দ্বিতীয় আসরের ফাইনালে প্রথমবারের মতো জায়গা করে নেয় অস্ট্রেলিয়া। টেস্ট শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের এই লড়াইয়ে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয় প্রথম আসরে শিরোপা বঞ্চিত হওয়া ভারত।
টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের জন্য ৬ জন ব্যাটার, ২ জন অলরাউন্ডার এবং ৩ পেসার নিয়ে দল সাজায় গত আসরের রানার্সআপ’রা। অপরদিকে, অজিরাও ৬ জন ব্যাটসম্যান, ১ জন স্পিনার, ১ জন অলরাউন্ডার এবং ৩ জন পেসার নিয়ে দল সাজায়।
দ্যা ওভালে টসে জিতে প্রথমেই বোলিং করার সিদ্ধান্ত নেন ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা। টসে হেরে ব্যাট করতে নেমেই ধাক্কা খায় সাদা হলুদ জার্সি ধারীরা। ১ম ইনিংসের চতুর্থ ওভারেই সিরাজের বলে কোনো রান না করেই সাজ ঘরে ফিরেন উসমান খাজা।
তারপর, তার বদলি হিসেবে নামা মার্নাস লাবুশেনকে নিয়ে দলের হাল ধরার চেষ্টা করেন আরেক ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার। কিন্তু, তিনিও বেশিক্ষণ মাঠে টিকে থাকতে পারেননি। শার্দুল ঠাকুরের বলে ক্যাচ আউট হয়ে ৪৩ রানে ফিরেন তিনি, তার ফেরার সাথে সাথে মার্নাস লাবুশেনও তার পথ অনুসরণ করে সাজ ঘরে ফিরেন।
এরপর, দুই অজি মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান স্টিভেন স্মিথ এবং ট্রাভিস হেড দুই জনে মিলে দেখেশুনে ভারতীয় বোলারদের খেলতে থাকেন এবং দলের রানের চাকা সচল রাখেন। দুই জনই ধৈর্য সহকারে ব্যাটিংয়ের মাধ্যমে নিজেদের অর্ধ শতক পূর্ণ করে শতকের দিকে এগিয়ে যান।
ট্রাভিস হেড নিজের টেস্ট ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ সেঞ্চুরি তুলে নেওয়ার পর স্টিভেন স্মিথও তার শতক পূর্ণ করেন। এই দুই অজি ব্যাটসম্যানের সুন্দর পার্টনারশিপ চলতে থাকলে ট্রাভিস হেড নিজের ক্যারিয়ারে চতুর্থবারের মতো ১৫০ রান পূর্ণ করেন।
১৬৩ রানের দূর্দান্ত ইনিংস খেলে মোহাম্মদ সিরাজের বলে ট্রাভিস প্যাভিলিয়নে ফিরলে তার পরিবর্তে নামা কেমরুন গ্রিনও এর কিছুক্ষণ পরই আউট হয়ে যান। তারপর, ১২১ রানে স্টিভেন স্মিথ প্যাভিলিয়নে ফিরলে এরপর নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে অস্ট্রেলিয়া।
তন্মধ্যে উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান অ্যালেক্স ক্যারির ৪৮ রানের ছোট এক ক্যামিও ইনিংসের ফলে শেষ পর্যন্ত ১০ উইকেট হারিয়ে প্রথম ইনিংস শেষে ৪৬৯ রানের ভালো সংগ্রহ পায় অজিরা।
ভারত প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ভালো শুরুর আশ্বাস দিলেও দলের জন্য ভালো কিছু করতে পারেননি ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত শর্মা। তার আউট হওয়ার সাথে সাথে তার সঙ্গী ওপেনার শুভমান গিলও একই পথে ফিরে যান। এরপর, চেতেশ্বর পুজারা ও ভিরাট কোহলি কেউই মাঠে বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারেননি।
অলরাউন্ডার রাবিন্দ্র জাদেজা ৪৮ রানের ইনিংস খেলে ন্যাথান লায়নের বলে আউট হলে উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান কে.এস ভারতও জাদেজার পথের দিশারি হন। যার ফলে তিনিও সাজ ঘরে ফিরেন মাত্র ৫ রান করে।
তারপর, শার্দুল ঠাকুর এবং আজিঙ্কা রাহানে অজি বোলারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। দুই জনই ধৈর্য সহকারে অজি বোলারদের বিরুদ্ধে দেখেশুনে খেলতে থাকেন এবং রানের চাকা সচল রাখেন। রাহানে ও ঠাকুর দুই জনকেই ক্যাচ মিস করে আউট করতে ব্যর্থ হলে দুই জনই অজিদের বিপক্ষে নিজেদের অর্ধ শতক তুলে নেন।
অজি দলনেতা প্যাট কামিন্সের বলে রাহানে ৮৯ রান করে আউট হলে আর কোনো ভারতীয় খেলোয়াড়ই ভালো কোনো ইনিংস দলকে উপহার দিতে পারেনি। ফলে, শার্দুল ঠাকুরের ৫১ রানের উপর ভর করে ২৯৬ রান করে ফলো অন এড়াতে সক্ষম হয় ভারত।
ভারতকে ২৯৬ রানে অলআউট করায় ১৭৩ রানের বিশাল লিড পায় অস্ট্রেলিয়া। দ্বিতীয় ইনিংসে ভারতের সামনে লক্ষ্য নির্ধারণে ব্যাট করতে নেমে আবারও বড় ইনিংস খেলতে ব্যর্থ হন দুই অজি ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার এবং উসমান খাজা। দুই ওপেনার ব্যর্থ হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরলেও দলের হাল ধরেন দুই মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান মার্নাস লাবুশেন এবং স্টিভেন স্মিথ।
স্মিথ ৩৪ রানের ছোট্ট ইনিংস খেলে জাদেজার বলে আউট হলে তার দেখানো পথে ১৮ রান করে সাজ ঘরে ফিরেন প্রথম ইনিংসে অজিদের হয়ে সেঞ্চুরি করা আরেক ব্যাটসম্যান ট্রাভিস হেড।
চতুর্থ দিনে খেলার শুরুতেই ৪১ রানে লাবুশেনকে ফিরিয়ে অজিদের পঞ্চম উইকেট তুলে নেন উমেশ যাদব। এরপর, গ্রিন এবং অ্যালেক্স ক্যারি দুই জনই ধীরে ধীরে দলকে রান এনে দেন৷ গ্রিন ২৫ রান করে আউট হয়ে ফিরলেও অপরপ্রান্ত ঠিকই আগলে রেখে নিজের অর্ধশতক পূর্ণ করেন অ্যালেক্স ক্যারি।
মিচেল স্টার্ক ৪১ রান করে আউট হওয়ার পর অজি অধিনায়কও ৫ রান করে প্যাভিলিয়নে ফিরলে ২৭০ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংস ডিক্লেয়ার ঘোষণা করে অ্যান্ড্রু মেকডোনাল্ড শিষ্যরা। অ্যালেক্স ক্যারি ৬৬ রান করে অপরাজিত থাকেন।
ফলে, ভারতের সামনে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার জন্য ৪৪৪ রানের বিশাল লক্ষ্য দাঁড়ায়। পাহাড় সমান টার্গেট তাড়া করতে নেমে ইনিংসের শুরুতেই হোঁচট খায় ভারত। স্কট বোল্যান্ডের বলে মাত্র ১৮ রান করে আউট হয়ে পরপর দুই ইনিংসে ব্যর্থ হন সদ্য সমাপ্ত আইপিএলে সাড়া জাগানো ব্যটাসম্যান শুভমান গিল।
তার যাওয়ার পর কিছু সময় পেরোতে না পেরোতেই ৪৩ রান করে সাজ ঘরে ফিরেন ভারত দলপতি রোহিত শর্মা। তারপর, তার সঙ্গী চেতেশ্বর পুজারাও তার দেখানো পথ অনুসরণ করে প্যাভিলিয়নে ফিরেন মাত্র ২৭ রান করে।
অজিদের বোলারদের কাছে ভুগতে থাকা ভারত দলের ব্যাটিং হাল ধরেন দলের সাবেক অধিনায়ক ভিরাট কোহলি এবং আজিঙ্কা রাহানে। দুই মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানই দেখেশুনে খেলে ১৬৪ রান সংগ্রহ করে চতুর্থ দিনের খেলা শেষ করেন।
শেষ দিনে জয়ের জন্য ভারতের প্রয়োজন ছিল ২৮০ রান এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ছিল ৭ উইকেট। এমন সমীকরণ নিয়ে পঞ্চম এবং শেষদিনের খেলায় ব্যাটিং করতে নামে ভারত এবং বোলিংয়ে আসে অজিরা।
পঞ্চম দিনের শুরুটা ভালো করার চেষ্টা করলেও ইনিংসের ৪৭তম ওভারে স্কট বোল্যান্ড যথাক্রমে একই সাথে ভিরাট কোহলি এবং রাবিন্দ্র জাদেজাকে ফিরিয়ে দিয়ে ভারতের ব্যাটিং দূর্গে জোড়া আঘাত করলে ম্যাচ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। বোল্যান্ড একই ওভারে ভিরাট কোহলিকে ফেরান ৪৯ করে এবং অলরাউন্ডার রাবিন্দ্র জাদেজাকে ফেরান শূন্য রানে।
আজিঙ্কা রাহানে দলকে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালালেও ৪৬ রান করে তিনিও মিচেল স্টার্কের শিকার হয়ে মাঠ ছাড়েন। তার বদলি হিসেবে নামা এবং গত ইনিংসে অর্ধশতক করা শার্দুল ঠাকুর দ্বিতীয় ইনিংসে ভারতীয়দের আস্থার প্রতিদান দিতে ব্যর্থ হন।
শার্দুলের বিদায়ের পর নিয়মিত বিরতিতে উমেশ যাদব, কে.এস ভারতদের উইকেট হারাতে থাকে সাদা নীল জার্সি ধারীরা। অবশেষে, ইনিংসের ৬৪তম ওভারের তৃতীয় বলে ন্যাথান লায়নের শিকার হয়ে মোহাম্মদ সিরাজ ১ রান করে আউট হলে ২৩৪ রানে ভারতের ইনিংস থামে।
ফলে, ২০৯ রানের বিশাল জয়ে আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের দ্বিতীয় আসরের শিরোপা ঘরে তুলে অস্ট্রেলিয়া। ব্যাটিংও বোলিং দুই বিভাগেই নিজেদের সেরাটা দিয়ে প্রথমবারের মতো টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করে অজিরা।
ভারতের ব্যাটিং ব্যর্থতা এবং প্রথম ইনিংসের বাজে বোলিংয়ের কারণে টানা দ্বিতীয় বারের মতো আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল হারতে হয় ভারতকে।
টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়ের মাধ্যমে ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে আইসিসির সব ধরনের টুর্নামেন্টের শিরোপা জয় করলো অস্ট্রেলিয়া। ফাইনালে প্রথম ইনিংসে ১৬৩ রানের দূর্দান্ত ইনিংস খেলে ম্যাচ সেরা হন অজি ব্যাটসম্যান ট্রাভিস হেড।