গর্ভাবস্থায় বাচ্চার ওজন চার্ট

গর্ভাবস্থায় বাচ্চার ওজন চার্ট কেমন হওয়া উচিত? জানুন বিস্তারিত তথ্য!

গর্ভাবস্থায় বাচ্চার ওজন চার্ট খেয়াল রাখা অতীব জরুরি। কেননা নির্দিষ্ট অবস্থায় বাচ্চার ওজন প্রিম্যাচ্যুর বার্থ থেকে রক্ষা করে। আর তাই এই সম্পর্কে জানতে আমাদের আজকের আয়োজন।

লেখাটি শেষ পর্যন্ত পড়ে জেনে নিন গর্ভাবস্থায় আপনার বাবুর ওজন কেমন হওয়া উচিত। 

গর্ভাবস্থায় বাচ্চার ওজন চার্ট – Baby Weight Chart During Pregnancy 

গর্ভাবস্থায় বাচ্চার ওজন চার্ট হলো গর্ভের শিশুর ওজনের একটি আদর্শ মান যা গর্ভাবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবর্তিত হয়। এই চার্টটি গর্ভবতী মায়ের ওজন, গর্ভের শিশুর গড় ওজন এবং অন্যান্য বিভিন্ন কারণ বিবেচনা করে তৈরি করা হয়।

গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস, বাচ্চার ওজন খুব একটা বাড়ে না। প্রথম তিন মাসের শেষে, বাচ্চার ওজন প্রায় ৫৬ থেকে ৭০ গ্রাম হয়। দ্বিতীয় তিন মাসে, বাচ্চার ওজন দ্রুত বাড়তে শুরু করে। দ্বিতীয় তিন মাসের শেষে, বাচ্চার ওজন প্রায় ১.৪ থেকে ২ কেজি হয়। তৃতীয় তিন মাসে, বাচ্চার ওজন আরও ধীর গতিতে বাড়তে থাকে। তৃতীয় তিন মাসের শেষে, বাচ্চার ওজন প্রায় ৩.৪ থেকে ৩.৮ কেজি হয়।

নীচে গর্ভাবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে গর্ভের শিশুর ওজনের একটি চার্ট দেওয়া হলো:

গর্ভাবস্থার সপ্তাহবাচ্চার ওজন (গ্রাম)
1256-70
20227-270
24340-400
28453-526
32566-640
36680-754
403.4-3.8

গর্ভাবস্থায় বাচ্চার ওজন চার্টটি শুধুমাত্র একটি আদর্শ মান। বাচ্চার ওজন এই চার্টের বাইরে থাকলেও তা উদ্বেগের কারণ নয়। তবে, যদি বাচ্চার ওজন খুব বেশি বা খুব কম হয়, তাহলে তা বিভিন্ন জটিলতার কারণ হতে পারে।

গর্ভের শিশুর ওজন বেশি হলে, তা প্রসবকালীন জটিলতা, গর্ভাবস্থার শেষের দিকে ডায়াবেটিস এবং গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপের মতো সমস্যার কারণ হতে পারে। গর্ভের শিশুর ওজন কম হলে, তা প্রসবকালীন জটিলতা, জন্মগত ত্রুটি এবং জন্মের পরে শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশে সমস্যার কারণ হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় বাচ্চার ওজন স্বাভাবিক রাখতে, মায়ের সুষম খাদ্য গ্রহণ এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা জরুরি। সুষম খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে মায়ের শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টির ঘাটতি পূরণ হয় এবং বাচ্চার বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করা হয়। নিয়মিত ব্যায়াম করলে মায়ের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং বাচ্চার ওজন স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।

গর্ভাবস্থায় বাচ্চার ওজন স্বাভাবিক রাখতে, মায়ের নিম্নলিখিত বিষয়গুলি খেয়াল রাখা উচিত:

  • নিয়মিত ডাক্তারের চেকআপ করা
  • সুষম খাদ্য গ্রহণ করা
  • নিয়মিত ব্যায়াম করা
  • অতিরিক্ত চিনি, লবণ এবং চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা
  • পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করা

কী খেলে গর্ভাবস্থায় বাচ্চার ওজন বাড়বে?

গর্ভবতী মায়ের সুষম খাদ্য গ্রহণ করলে গর্ভের সন্তানের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। গর্ভবতী মায়ের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে:

  • প্রোটিন: প্রোটিন ভ্রূণের বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য অপরিহার্য। প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারগুলির মধ্যে রয়েছে মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, মটরশুটি, দুগ্ধজাত পণ্য ইত্যাদি।
  • ক্যালসিয়াম: ক্যালসিয়াম হাড় ও দাঁতের গঠনের জন্য প্রয়োজনীয়। ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারগুলির মধ্যে রয়েছে দুধ, দই, পনির, ব্রকলি, বাদাম ইত্যাদি।
  • আয়রন: আয়রন রক্ত তৈরির জন্য প্রয়োজনীয়। আয়রন সমৃদ্ধ খাবারগুলির মধ্যে রয়েছে লাল মাংস, মুরগির মাংস, কলিজা, ডাল, গাজর, কলা ইত্যাদি।
  • ভিটামিন ডি: ভিটামিন ডি হাড় ও দাঁতের গঠনের জন্য প্রয়োজনীয়। ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবারগুলির মধ্যে রয়েছে সূর্যের আলো, চর্বিযুক্ত মাছ, ডিম, দুগ্ধজাত পণ্য ইত্যাদি।
  • ফলিক অ্যাসিড: ফলিক অ্যাসিড গর্ভপাত ও গর্ভের শিশুর জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবারগুলির মধ্যে রয়েছে সবুজ শাকসবজি, ফল, মটরশুটি, ডাল, দুধ ইত্যাদি।

গর্ভবতী মায়ের খাদ্য তালিকায় এই পুষ্টি উপাদানগুলির সমন্বয় রাখলে গর্ভের সন্তানের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। এছাড়াও, গর্ভবতী মায়ের অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে।

এছাড়াও, গর্ভবতী মায়ের কিছু খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। যেমন:

  • কাঁচা বা আধাসেদ্ধ মাংস, ডিম, মাছ: এই খাবারগুলিতে টক্সোপ্ল্যাজমা নামক পরজীবী থাকতে পারে, যা গর্ভপাত বা গর্ভের শিশুর জন্মগত ত্রুটির কারণ হতে পারে।
  • পাস্তুরায়ন ছাড়া দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য: এই খাবারগুলিতে লিস্টেরিয়া নামক ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে, যা গর্ভপাত বা গর্ভের শিশুর জন্মগত ত্রুটির কারণ হতে পারে।
  • কাঁচা বা আধাসেদ্ধ শাকসবজি: এই শাকসবজিতে সালমোনেলা বা ই.কোলাই নামক ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে, যা গর্ভপাত বা গর্ভের শিশুর সংক্রমণের কারণ হতে পারে।
  • অতিরিক্ত চিনি বা শর্করা জাতীয় খাবার: এই খাবারগুলি গর্ভের শিশুর ওজন বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়ায়।

গর্ভবতী মায়ের যদি কোনো নির্দিষ্ট খাবার সম্পর্কে প্রশ্ন বা উদ্বেগ থাকে তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত।

গর্ভাবস্থায় বাচ্চার ওজন কম হওয়ার কারণ

গর্ভাবস্থায় বাচ্চার ওজন কম হলে তা শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। অকাল প্রসবের শিশুরা বিভিন্ন জটিলতার ঝুঁকিতে থাকে। যেমন, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, রক্তস্বল্পতা, অটিজম ইত্যাদি।

গর্ভাবস্থায় বাচ্চার ওজন কম হওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণগুলি হল:

  • মায়ের অপুষ্টি: গর্ভাবস্থায় মায়ের পর্যাপ্ত পুষ্টি না পেলে গর্ভের শিশুর ওজন বাড়ে না। মায়ের পুষ্টির অভাবে গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ ব্যাহত হয়।
  • মায়ের অসুস্থতা: গর্ভাবস্থায় মায়ের কোনো অসুস্থতা থাকলে তা গর্ভের শিশুর ওজন বাড়তে বাধা দিতে পারে। যেমন, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগ ইত্যাদি।
  • গর্ভের শিশুর জন্মগত ত্রুটি: গর্ভের শিশুর কোনো জন্মগত ত্রুটি থাকলে তা তার বৃদ্ধি ও বিকাশে প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে গর্ভের শিশুর ওজন কম হতে পারে।
  • গর্ভপাতের ঝুঁকি: গর্ভপাতের ঝুঁকি কমাতে গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে মায়েদের ওষুধ সেবন করতে হয়। এই ওষুধগুলি গর্ভের শিশুর ওজন কমাতে পারে।
  • গর্ভের শিশুর অকাল জন্ম: পূর্ণ মেয়াদে গর্ভধারণের সময় ৪০ সপ্তাহ। এর আগে গর্ভের শিশু যদি জন্মগ্রহণ করে, তবে তাকে অকাল প্রসবের শিশু বলা হয়। অকাল প্রসবের শিশুদের ওজন সাধারণত কম থাকে।

গর্ভবতী মায়েরা নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করে গর্ভের শিশুর ওজন কম হওয়ার ঝুঁকি কমাতে পারেন:

  • পর্যাপ্ত পুষ্টি গ্রহণ করা: গর্ভবতী মায়েদের দিনে অন্তত ২,২০০ ক্যালোরির খাবার গ্রহণ করা উচিত। এছাড়াও, তাদের প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফলিক অ্যাসিড ইত্যাদি পুষ্টি উপাদান পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত।
  • নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া: গর্ভবতী মায়েদের নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ডাক্তার গর্ভবতী মায়ের ওজন ও গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করেন। যদি গর্ভবতী মায়ের ওজন কম থাকে বা গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি স্বাভাবিক না হয়, তবে ডাক্তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন।
  • স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করা: গর্ভবতী মায়েদের ধূমপান, মদ্যপান ও অতিরিক্ত ওজন বাড়ানো এড়িয়ে চলতে হবে। এছাড়াও, তাদের নিয়মিত ব্যায়াম করা উচিত।

গর্ভবতী মায়েদের নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ডাক্তার গর্ভবতী মায়ের ওজন ও গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করেন। যদি গর্ভবতী মায়ের ওজন কম থাকে বা গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি স্বাভাবিক না হয়, তবে ডাক্তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন।

গর্ভাবস্থায় মায়ের ওজন চার্ট – Mother’s Weight Chart During Pregnancy 

গর্ভাবস্থায় মায়ের ওজন চার্ট কেমন হওয়া উচিত তা নির্ভর করে মায়ের গর্ভধারণের আগের ওজনের উপর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর মতে, গর্ভধারণের আগের ওজনের উপর ভিত্তি করে মায়েদের জন্য গর্ভাবস্থায় আদর্শ ওজন বৃদ্ধির পরিমাণ নিম্নরূপ:

গর্ভধারণের আগের ওজনগর্ভাবস্থায় আদর্শ ওজন বৃদ্ধির পরিমাণ
খুব কম ওজন (BMI <18.5)12.5-18 কেজি
স্বাভাবিক ওজন (BMI 18.5-24.9)11.5-16 কেজি
অতিরিক্ত ওজন (BMI 25-29.9)7-11.5 কেজি
স্থূল (BMI ≥30)5-9 কেজি

গর্ভাবস্থায় মায়ের ওজন বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা গুরুত্বপূর্ণ। খুব বেশি বা খুব কম ওজন বৃদ্ধি উভয়ই মা ও শিশুর জন্য স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে।

গর্ভাবস্থায় মায়ের ওজন বৃদ্ধির হারও গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে মায়ের ওজন বৃদ্ধি খুব বেশি হওয়া উচিত নয়। এরপর থেকে গর্ভাবস্থার শেষ দিকের দিকে ওজন বৃদ্ধি দ্রুত হতে থাকে।

গর্ভবতী মায়ের ওজন বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টি গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। মায়েদের দিনে অন্তত ২,২০০ ক্যালোরির খাবার গ্রহণ করা উচিত। এছাড়াও, তাদের প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফলিক অ্যাসিড ইত্যাদি পুষ্টি উপাদান পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত।

গর্ভবতী মায়েদের নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ডাক্তার গর্ভবতী মায়ের ওজন ও গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করেন। যদি গর্ভবতী মায়ের ওজন বৃদ্ধি স্বাভাবিক না হয়, তবে ডাক্তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন।

শেষ কথা 

অতএব গর্ভাবস্থায় বাচ্চার ওজন চার্ট নিয়ে নিশ্চয় আপনার আর কোনো দ্বিধা থাকলো না। আমাদের ও ডাক্তারের পরামর্শ মেনে নাই অবশ্যই সে অনুযায়ী খাদ্যাভাস গড়ে তুলুন এবং সুস্থ থাকুন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top