ঘন ঘন প্রস্রাবের কারণে দৈনন্দিন জীবনে মানুষকে বহু অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। এ রোগে ভুক্তভোগী রোগীরা দিন বা রাত উভয় সময়েই স্বাভাবিকের চেয়ে পরিমাণে কম হলেও বার বার প্রস্রাব করার প্রয়োজনীতা অনুভব করেন।
মানব দেহের নিম্ন জনন-মূত্র নালি বা লোয়ার ইউরোজেনিটোল ট্রাক্ট এ কোন ডিজঅর্ডারের কারণে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া একটি অস্বস্তিকর ব্যাপার। ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণে অনেকেই না বুঝে তা থেকে মুক্তি পাবার জন্য এন্টিবায়োটিক খেয়ে থাকেন। আবার অনেকেই মনে করেন ঘন ঘন প্রস্রাব মানেই ডায়াবেটিস, বিষয়টি আসলে তা নয়। ডায়াবেটিস ছাড়াও ঘন ঘন প্রস্রাবের পেছনে বহু কারণ থাকতে পারে। আজকের আর্টিকেলের মূল বিষয়বস্ত হলো ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণ ও প্রতিকার। চলুন তাহলে এ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।
Table of Contents
ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণ ও প্রতিকার
বিভিন্ন কারণে আমাদের ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা দেখা দিতে পারে। আমরা প্রথমেই জেনে নিব ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণ গুলি কি কি ?
১. ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার প্রধান কারণ হলো পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা।
২. শীতকালীন মানুষের শরীর থেকে ঘাম বের হয় না। যার ফলে শীত মৌসুমে মানুষের ঘন ঘন প্রস্রাব হয়।
৩. ছাত্র ছাত্রীদের পরীক্ষা কালীন সময় বা চাকরি ক্ষেত্রে কোন ইন্টারভিউ দেয়ার পূর্বে এ সমস্যাটি দেখা দেয়।
৪. কিছু রোগের লক্ষণ যেমন ডায়াবেটিস, প্রস্টেট গ্রন্থির টিউমার এবং প্রস্রাবে জীবাণু সংক্রমণ ইত্যাদি কারণে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়।
৫. প্রস্রাবে ইনফেকশন হলে ঘন ঘন প্রস্রাবের সাথে জ্বালা পোড়া হবে।
৬. কিডনি অকেজো হয়ে পড়া ঘন ঘন প্রস্রাবের একটি অন্যতম কারণ।
৭. পুরুষদের প্রস্টেটে ইনফেকশন হবার ফলেও ঘন ঘন প্রস্রাব হতে পারে।
৮. মেয়েদের গর্ভকালীন সময়ে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়।
৯. প্রস্রাবের থলিতে ক্যান্সার হলে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়, প্রস্রাবে জ্বালা পোড়া এমনকি রক্তও বের হতে পারে।
১০. মূত্রনালীর সংকোচন হলে ঘন ঘন প্রস্রাব হয় এবং প্রস্রাবের সাথে জ্বালা পোড়া হতে পারে।
১১. যক্ষা বা TB রোগের কারণেও ঘন ঘন প্রস্রাব হতে পারে।
১২. ব্লাডার পাথর বা কিডনিতে এবং ব্লাডার ক্যান্সার হলে ঘন ঘন প্রস্রাব হতে পারে।
১৩. মেয়েদের পেলভিক ইনফ্লামেশন হলে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়।
১৪. প্রস্রাবের পথে কোন বাঁধা থাকলে ঘন ঘন প্রস্রাব হতে পারে।
১৫. যুবকদের উত্তেজক চিন্তার ফলে ঘন ঘন প্রস্রাব হতে পারে।
এছাড়াও অতিরিক্ত এলকোহল জাতীয় কোমল পানীয়, চা, কফি ইত্যাদি পান করার ফলেও ঘন ঘন প্রস্রাব হতে পারে।
পুরুষের ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণ
পুরুষের ঘন ঘন প্রস্রাব বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। নিচে কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ বর্ননা করা হলো।
স্ট্রোক
পুরুষদের ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার একটি সম্ভাব্য কারণ হলো স্ট্রোক। পুরুষদের স্ট্রোক হলে মূত্রাশয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয় যা বার বার প্রস্রাবের বেগ সৃষ্টি করে।
মূত্রতন্ত্রে সংক্রমণ
মূত্রতন্ত্রে সংক্রমণের কারণেও ঘন ঘন প্রস্রাব হতে পারে। অধিকাংশ পুরুষেরই প্রস্রাব চেপে রাখার কারণে মূত্রাশয়ে সংক্রমণ হয়ে থাকে। এছাড়াও কিডনিতে পাথর, কোষ্ঠকাঠিন্য, মূত্রনালীতে সাম্প্রতিক অস্ত্রপচার এবং সমকামীতার কারণেও পুরুষের মূত্রতন্ত্রে সংক্রমণের সৃষ্টি হয়ে থাকে। মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণের ফলে মূত্রাশয় ও মূত্রাশয়ের প্রাচীর উত্ত্যক্ত হয়ে ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ সৃষ্টি করে।
ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন
ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন অর্থাৎ মুত্রথলি বা কিডনিতে ইনফেকশন হলে তা থেকে ঘন ঘন প্রস্রাব হতে পারে।
ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিস রোগীদের ঘন ঘন প্রস্রাব হয়। কারণ ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি পায় ফলে কিডনির শর্করা ব্যবস্থাপনার কাজও বেড়ে যায়। কিন্তু কিডনি এ কাজে ব্যর্থ হয় ফলে মূত্রনালী থেকে অতিরিক্ত গ্লুকোজ প্রস্রাবের মধ্যে দিয়ে বের হয়ে যায়। এ কারণেই ডায়াবেটিস রোগীদের ঘন ঘন প্রস্রাব হয়।
ইন্টারস্টিশিয়াল সিস্টাইটিস
ইন্টারস্টিশিয়াল স্টিস্টাইটিস হলো একটি দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা যা ঘন ঘন প্রস্রাব, মূত্রাশয়ে চাপ ও ব্যথার কারণ হতে পারে। ইন্টারস্টিশিয়াল সিস্টাইটিসের ফলে মূত্রাশয় ড্যামেজ হয়ে পড়ে, প্রস্রাব হওয়ার প্রবনতা বৃদ্ধি পায় এবং মূত্রাশয় ব্যথা করতে পারে।
অতিক্রিয়াশীল মূত্রাশয়
অতিক্রিয়াশীল মূত্রাশয় ( ওএবি) এর কারণে ঘন ঘন প্রস্রাব হতে পারে। যেসব পুরুষদের প্রস্টেট সমস্যা বা স্নায়ুতাত্বিক রোগ রয়েছে তাদের মূত্রাশয় অতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়ে।
একজন পুরুষ যখন ওএবি-তে ভোগেন তখন তার প্রস্রাব ধরে রাখার ক্ষমতা কমে যায়। যার ফলে ওএবি-এর পুরুষেরা রাতে প্রস্রাব করতে ঘন ঘন বিছানা ছাড়েন।
মেয়েদের ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণ ও প্রতিকার
নারীদের ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণ হলো বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রস্রাবে ইনফেকশন বা ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। যার ফলে নারীদের ঘন ঘন প্রস্রাব হয়।
গর্ভকালীন সময়ে নারীদের ঘন ঘন প্রস্রাব হয়। কারণ গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে নারীদের হরমোনের পরিবর্তন হয় এবং ক্রমবর্ধমান জরায়ু মূত্রাশয়কে চাপ দিতে থাকে ফলে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়।
অনেক সময় নারীদের ৫০ বছরের মধ্যে যে কোন সময় জরায়ু ফাইব্রয়েড পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। কখনো কখনো জরায়ু ফাইব্রয়েড বড় হয়ে যায় ফলে প্রস্রাবের মাত্রা বেড়ে যায়।
এছাড়াও যে সমস্ত নারীরা কোষ্ঠকাঠিন্য এবং ডায়াবেটিস রোগে ভুগছেন তাদের ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার সমস্যাটি দেখা দেয়।
ঘন ঘন প্রস্রাব এর প্রতিকার – ঘন ঘন প্রস্রাব হলে কি ওষুধ খাওয়া উচিত
ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কিছু ঘরোয়া উপায় আছে যা মেনে চললে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। যেমন-
কাঁচা লবণ পরিহার করুন
যারা অধিক পরিমাণে লবণ গ্রহণ করেন তাদের ক্ষেত্রে ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যাটি দেখা দেয়। খাবারে অতিরিক্ত লবণ বা কাঁচা লবণ গ্রহণ করার ফলে বার বার প্রস্রাবের বেগ আসতে পারে। তাই এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে কাঁচা লবণ খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
প্রস্রাবের সমস্যা দূর করতে জিরা
জিরা শুধু ঘন ঘন প্রস্রাব নয় হজমের সমস্যাও দূর করে থাকে। ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা দূর করতে প্রতিদিন এক গ্লাস হালকা কুসুম গরম পানিতে জিরা ভিজিয়ে খান অথবা জিরা ভেজানো পানি খান এতে সমস্যা দূর হয়ে যাবে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন
ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা দূর করতে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করুন। কারণ অতিরিক্ত ওজন মূত্রাশয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, স্থুলকায় রোগীরা তাদের ওজনের দশ শতাংশ কমিয়েছে, যার ফলে মূত্রাশয়ের নিয়ন্ত্রণ আগের তুলনায় ৫০ শতাংশ উন্নত হয়েছে। সুতরাং প্রস্রাবের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে ওজন কমানোর চেষ্টা করুন।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে হবে
ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার একটি অন্যতম কারণ হলো কোষ্ঠকাঠিন্য। তাই কোষ্ঠকাঠিন্য যাতে না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, বেশি পরিমাণে মিষ্টি আলু, মটরশুঁটি, আপেল, কলা, চেরি ফল এবং বাদামী চাল খেলে প্রস্রাবের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
নিয়মিত দই খান
দই আমাদের শরীরের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান। এর প্রবায়োটিক পাচনতন্ত্রের সঠিক ক্রিয়াকলাপ বজায় রাখতে সাহায্য করে। দই ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা দূর করার পাশাপাশি কিডনিকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
পালং শাক
পালং শাকের মধ্যে রয়েছে অবাক করা কার্যকারিতা যা ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা দূর করার পাশাপাশি প্রস্রাবের কম বা বেশি ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে পালং শাক সেদ্ধ করে স্যুপ তৈরি করে খেতে পারেন।
এলোভেরা
চুলের যত্ন ও রূপচর্চার পাশাপাশি দেহের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে এলোভেরা কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে এলোভেরা থেকে জেল বের করে তাতে পরিমাণ মতো পানি মিশিয়ে খান এতে উপকার পাবেন।
দারুচিনির গুড়ো
দারুচিনির গুড়ো প্রস্রাবের ঘন ঘন বেগ কমাতে বিশেষ ভুমিকা রাখে। এর এন্টিইনফ্লেমেটরি উপাদান প্রস্রাবের সমস্যা দূর করার পাশাপাশি প্রস্রাবে জ্বালা পোড়া এবং কিডনির যত্নেও বেশ উপকারী। এক্ষেত্রে আপনি দারুচিনির গুড়ো পানিতে মিশিয়ে কিংবা শুধু গুড়োও খেতে পারেন।
বেকিং সোডা
ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে বেকিং সোডার জুড়ি মেলা ভার। এক্ষেত্রে এক গ্লাস পানির সাথে পরিমাণ মতো বেকিং সোডা মিশিয়ে একটানা তিন থেকে চার দিন খেতে থাকুন প্রস্রাবের সমস্যা দূর হয়ে যাবে।
প্রসাবের সমস্যা দূর করতে আরো কিছু টিপস
- ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে কোন প্রকার তরল খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন এবং পরিমাণ মতো পানি পান করুন।
- কফি বা ক্যাফেইন যুক্ত খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুন।
- এলকোহল, চা এবং সোডা খাওয়া পরিহার করুন।
- ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন। কারণ অতিরিক্ত ওজন মূত্রাশয়ের ওপর চাপ ফেলে।
- মসলাযুক্ত খাবার খাওয়া যাবে না।
- সাইট্রাস ফল গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুন।
- প্রস্রাব দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখার অভ্যাস দূর করুন।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায় ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া একটি অস্বস্তিকর ব্যাপার। নারী বা পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই এ সমস্যাটি হতে পারে। অনেকের দিনে আবার অনেকের রাতে এই সমস্যাটা দেখা যায়।
তবে ওপরে উল্লেখখিত ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানার পর সে অনুযায়ী নিয়মকানুন মেনে চলার পরেও যদি ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার সমস্যা থেকে মুক্তি না মেলে তবে কি কারণে ঘন ঘন প্রস্রাব হচ্ছে তা নির্নয় করতে হবে এবং সে অনুযায়ী প্রপার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নিতে হবে। নিয়মিত হোমিও চিকিৎসার মাধ্যমে ধীরে ধীরে এই সমস্যা দূর হয়ে যাবে।