নিউরোলজি (Neurology) চিকিৎসা বিভাগের একটি শাখা যেখানে নার্ভাস সিস্টেম বা স্নায়ু তন্ত্র ও তার বিভিন্ন সমস্যা বা রোগ নিয়ে আলোচনা করা হয়ে থাকে।
অন্য রোগের লক্ষণ এবং উপসর্গ দেখতে পেলে আমরা বুঝি আমাদের কী রোগ হয়েছে। কিন্তু নিউরোলজি রোগের বিস্তৃতি ও জটিলতা সম্পর্কে আমাদের অনেকের স্পষ্ট ধারণা নেই। যার ফলে বাঁধে বিপত্তি ঘটে।
তাই আজকে আমরা আলোচনা করবো নিউরোলজি রোগের লক্ষণ নিয়ে।
Table of Contents
নিউরোলজি (Neurology) রোগের লক্ষণ
বয়স বাড়ার সাথে সাথে কমজোর হতে থাকে স্নায়ু অর্থাৎ নার্ভের সক্রিয়তা। ফলে শরীরে বাসা বাঁধে নিউরোলজি ঘটিত নানান রোগ৷ নিউরোলজি রোগে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে যেসকল লক্ষণ প্রায়শই দেখা যায় তা নিচে আলোচনা করা হলো। তাহলে আসুন জেনে নিই নিউরোলজি রোগের লক্ষণগুলো:
১. মাথাব্যথা
আজ অবধি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যার মাথাব্যথা হয়নি। ডাক্তাররা বলেন, মাথাব্যথার তীব্রতা কত দিন অন্তর হচ্ছে, তার উপরে নজর রাখতে হবে।
মাথা ব্যথার সঙ্গে বমি, জ্বর, চোখে দেখার সমস্যা মতো উপসর্গ যদি দেখা যায়, বুঝতে হবে সমস্যাটি নিউরোলজি রোগের লক্ষণ। তাই দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
২. হাত কাঁপা
নিউরোলজি সমস্যার ক্ষেত্রে হাত কাঁপা বহুল প্রচলিত একটি উপসর্গ। বয়স্কদের মধ্যে এই ধরনের সমস্যা দেখা যায়।
অনেকে ভাবেন বয়স্ক শরীরে শক্তি কমে যাওয়ার জন্য এমন হয়। আসলে কিন্তু তা নয়,এটি একটি নিউরোলজি সংক্রান্ত রোগ।
এছাড়াও রোগীর হাঁটা-চলা অস্বাভাবিক ভাবে ধীর গতির হয়ে যায়। যে কাজটির ক্ষেত্রে আগে তাঁর পাঁচ মিনিট লাগত, সেটি করতে প্রায় বিশ লেগে যায়।
এধরনের সমস্যার লক্ষণ আস্তে আস্তে প্রকাশ এবং আস্তে আস্তে প্রকট আকার ধারণ করে।
৩. ব্যথা
ব্যথা নিউরোলজি রোগের অন্যতম সাধারণ লক্ষণ। বয়সে বৃদ্ধির সঙ্গে ব্যথা বাড়তে থাকে। ব্যথা শরীরের নিদিষ্ট অংশে নাহয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা হয়। যেমন পিঠে ব্যথা, ঘাড়ে ব্যথা, হাত-পা ব্যথা এবং জয়েন্টে ব্যথা হতে পারে।
এধরনের ব্যথা সবসময় না হয়ে একটি নিদিষ্ট সময়ে হয়ে থাকে। এছাড়াও হাত-পা ও শরীরের মাংসপেশি শক্ত হয়ে যায়। যেখান থেকে পরবর্তীতে ব্যথা সৃষ্টি হয়। এমন সমস্যা দেখা দিলে এড়িয়ে না গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
৪. ঘুমের সমস্যা
ঘুম ঠিকমতো না হওয়া সমস্যাও একটি নিউরোলজি লক্ষণ। এ সমস্যায় ভোগা রোগীরা অনেকদিন ধরে অনিদ্রা ভোগেন। সঠিক সময়ে তাদের নিদ্রা না এসে অনিয়মিত সময়ে নিদ্রা আসে।
এছাড়াও অনেক সময় রোগী ব্যথার কারণে রাতে ঠিক মতো ঘুমাতে পারে না। যা নিউরোলজি রোগের লক্ষণ।
৫. ভুলে যাওয়া
নিউরোলজি আরেকটা লক্ষণ হলো ভুলে যাওয়া। নিউরোলজি রোগে আক্রান্ত রোগীরা তাদের চোখে সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা মনে রাখতে সক্ষম হয় না।
অনেক সময় দেখা যায় রোগীরা পুরাতন ঘটনা মনে রাখতে সক্ষম হয় কিন্তু সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনা ব্যক্তির মন থেকে মুছে যায়।
৬. অসার অবস্থা
শরীরে অসাড়তা বা শরীরের আংশিক অংশ কাজ না করা নিউরোলজি রোগের লক্ষণ। আক্রান্ত ব্যাক্তিরা দেহের আক্রান্ত অংশটি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেন না।
তাই তাদের শরীরের ভারসাম্য রক্ষা, কাজ করা, সাইকেল এবং গাড়ি চালানো অসুবিধা হয়। পাশাপাশি হাঁটাচলা ক্রমশ ধীরগতি হয় এবং জড়তা দেখা দেয়।
এছাড়াও অন্য কোন শারীরিক কাজ সঠিকভাবে করতে পারে না। বয়স্কদের মধ্যে এ সমস্যা বেশি দেখা যায় এবং আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
উপরোক্ত লক্ষণ ছাড়াও আরো যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে-
১. গলার স্বরের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
২. কোষ্ঠকাঠিন্য বা চামড়ার নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়।
৩. ঘ্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলে।
৪. যৌন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা।
৫. খাবার গিলতে সমস্যা ও অনিয়ন্ত্রিত মূত্রত্যাগ।
স্নায়ুর ব্যথা থেকে মুক্তির উপায়
মেডিক্যাল রিপোর্ট অনুযায়ী, নিউরোলজি বা স্নায়ুর ব্যথা সামলানো খুব কঠিন নয়। স্নায়ুর বা নিউরোলজি ব্যথা এমন একটি ব্যথা এটি যার একবার হয়, তাকে সারাজীবন এই ব্যথার কষ্ট ভোগ করতে হয়।
বেশির ভাগ সময় সময়মতো চিকিৎসা পেলে এ ব্যথা কিছুদিনের মধ্যে কমে যায়। কিন্তু একবারে কমে যায় না। কয়েকটা উপায় আছে যাতে ব্যথাটা প্রশমিত করা যেতে পারে। এগুলো হলোঃ
- যতটা সম্ভব হালকা ব্যায়াম করুন। এতে শরীরের জয়েন্ট গুলো সচল হয়। রুটিনমতো কাজকর্মে নিযুক্ত থাকুন।
ব্যথা প্রশমিত করার সাহায্য জন্য দ্রুত হাঁটা এবং ব্যাক স্ট্রেচ (পিঠ, কোমর এবং শরীরের নীচের অংশের পেশী প্রসারিত করার ব্যায়াম) করতে পারেন।
- পিঠে ব্যথা হলে পিঠের পেশীগুলো শিথিল করার জন্য হিটিং প্যাড ব্যবহার করতে পারেন। হিটিং প্যাড সহজেই সব জায়গায় পাওয়া যায়। একটা হিটিং প্যাড একদিনে কয়েক বার ব্যবহার করা যেতে পারে।
- হিটিং প্যাড প্রয়োগের পর ব্যথামুক্তির মলম লাগাতে পারেন। এই মলমগুলো পেশী শিথিল করে করে ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। আবার হিটিং প্যাড এর তাপ ক্রিমটাকে আরও ভালোভাবে শুষে নিতে এবং দ্রুত কাজ করতে সাহায্য করে।
- যদি হিটিং প্যাডগুলো আপনাকে অস্বস্তি দেয়, উষ্ণ স্নান একটা ভাল বিকল্প হতে পারে।
- যদি আপনি আপনার পায়ে অসাড়তা অনুভব করেন। তাহলে অসাড়তা থেকে মুক্তি পেতে মাটির উপর পায়ের পাতাগুলি দ্বারা মৃদু আঘাত করা বা টোকা মারার চেষ্টা করুন। আবার আপনার পায়ের পাতাগুলি চক্রাকারে ঘোরাতে পারেন। এরপর কিছুক্ষণ হাঁটতে পারেন।
- ব্যথা থেকে তাৎক্ষণিক মুক্তি পেতে মাঝে মাঝে আপনি ব্যথামুক্তির ওষুধ খেতে পারেন। তবে আপনি অবশ্যই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করবেন।
- প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং মিষ্টিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন। এগুলো শরীরে প্রদাহ আরও বাড়িয়ে দেয়। সবুজ শাকসবজির মত প্রদাহ-প্রতিরোধক খাবার গ্রহণ করা সবচেয়ে ভালো। প্রদাহ কমাতে আদা চা, গ্রিন টি খুব সহায়ক হতে পারে। এটি নিয়মিত গ্রহণ করতে পারেন।
- ব্যথা কমাতে শক্ত জাজিমের উপরে ঘুমাতে পারেন। কিন্তু নিশ্চিত করুন সেটা যেন খুব বেশি শক্ত নয়। একই সাথে আবার নরম বিছানায় শোবেন না। বেশি নরম বিছানা ব্যথাটা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
নিউরোলজি (Neurology) রোগের চিকিৎসা
আমাদের শরীরে নিউরোলজি রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়া মাত্রই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। বর্তমানে নিউরোলজিস্ট চিকিৎসকগণ যে পদ্ধতিতে চিকিৎসা প্রদান করে থাকে তা নিচে আলোচনা করা হলোঃ
১. ব্যথামুক্তির ওষুধ
নিউরোলজি চিকিৎসা প্রথম এবং প্রধান পদ্ধতি হচ্ছে ব্যথামুক্তির ওষুধ। যা ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। চিকিৎসকগণ নিউরোলজি চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যথার মুক্তির জন্য, ব্যথা মুক্তির ঔষধ প্রেসক্রাইব করে থাকেন। এই ওষুধগুলো অল্পস্থায়ী ব্যথামুক্তি দিতে পারে।
২. এপিডিউর্যাল ইঞ্জেকশন
ঔষধ খাওয়ার পরে ব্যথা না কমলে ডাক্তাররা ব্যথামুক্তির জন্য সরাসরি মেরুদণ্ডের মধ্যে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ব্যথা কমিয়ে থাকেন। এই ধরনের চিকিৎসা নিউরোলজি চিকিৎসায় বেশ ভালো সুফল পেয়েছে।
৩. ফিজিওথেরাপি
নিউরোলজি ব্যথা কমাতে ফিজিওথেরাপি অত্যন্ত কার্যকর। ব্যথা দীর্ঘদিনের হলে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা দেওয়া হয। এটা ধীরে ধীরে ব্যথা নিরাময় করতে সাহায্য করে।
ব্যায়াম এবং ম্যাসাজ এর মাধ্যমে এই চিকিৎসা দেওয়া হয়। এটা ব্যথাটাকে শান্ত করতে এবং সেই সাথে উপসর্গগুলিকে কার্যকরভাবে কমাতে সাহায্য করে।
একজন ফিজিওথেরাপির তত্ত্বাবধানে এই চিকিৎসা প্রদান করা হয়।
৪. অস্ত্রোপচার
নিউরোলজি চিকিৎসা শেষ পদ্ধতি অস্ত্রোপচার। ব্যথা যদি আশানুরূপ না কমে এবং ভালো রকমের অস্বস্তি সৃষ্টি করে তাহলে চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অস্ত্রোপচার চিকিৎসা পদ্ধতি সহজ হলেও এটি একটি ব্যয়বহুল চিকিৎসা পদ্ধতি।
উপসংহার
নিউরোলজি রোগ এমন একটি রোগ যার লক্ষণ খুব ধীরে ধীরে মানবদেহে প্রকাশ পায় এবং পরবর্তীতে প্রকট আকার ধারণ করে। তাই নিউরোলজি রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়া মাত্র দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
Tag: neurological disorders, নিউরোলজি কি রোগ, নিউরোলজি অর্থ কি, নিউরোলজি কাকে বলে, নিউরোলজি ডাক্তার, নিউরোলজি মানে কি, নিউরোলজি কি, নিউরোলজি মেডিসিন, নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ, নিউরোলজি ডাক্তারের কাজ কি, নিউরোলজি রোগ কি, নিউরোলজি চিকিৎসা, নিউরোলজি সমস্যা কি, পেডিয়াট্রিক নিউরোলজি, নিউরোলজি রোগের চিকিৎসা, case reports in neurological medicine