পিত্তথলির পাথর

পিওথলির পাথর হবার কারণ? এর চিকিৎসা ও অপারেশন পরবর্তী নিয়ম!

পিত্তথলির পাথর বর্তমান সময়ে খুবই কমন একটি সমস্যা। মানুষের শরীরে পিত্ত কোষে অথবা পিত্তবাহী নালীতে পিত্তরস জমাট বেঁধে প্রস্তরকণা আকার ধারণ করে যাকে পিত্ত পাথরী বলা হয়। সাধারণত পিত্তবাহী নালীতে কোনো অসুবিধা দেখা দিলে এই রোগটি হতে পারে। তবে সচরাচর এই রোগটি অন্য কোনো কারণে হয় না বলে ধারণা করা হয়। 

এই রোগে পিত্ত কোষ বা গলব্লাডারে যে পিত্ত পাথর হয় তার আকার এবং প্রকার বিভিন্ন রকম। সাধারণত ছোট-বড়-মাঝারি গোলাকার, সাদা কালো কাটা সবুজ বর্ণ ইত্যাদি হতে পারে। বালু কণার মতো বা পায়রার ডিমের আকারেরও হতে পারে। পিত্তথলির পাথর হলে অবশ্যই অবহেলা না করে চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন।

পিওথলির পাথর হবার কারণ

গলব্লাডার বা পিত্তথলির পাথর বর্তমান সময়ে বহু মানুষের হয়ে থাকে। সাধারণত ৪০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের মধ্যে এ রোগের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তবে বেশ কিছু কারণে পিত্তথলির পাথর হতে পার। চলুন জেনে নেই পিত্তথলিতে পাথর হবার কারণ-

নিয়মিত পিল সেবন 

অনেক নারীই নিয়মিত পিল বা জন্মনিয়ন্ত্রণকরণ পিল গ্রহণ করে থাকেন। যা অনেক সময় নারীর শরীরে অনেক রোগের কারণ। একটানা পিল কখনই নারী স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। দীর্ঘদিন ধরে যেসব নারীরা হরমোনের ওষুধ খান ও নিয়মিত পিল গ্রহণ করেন তাদের পিত্তথলির পাথর হবার সম্ভাবনা খুবই বেশি। 

গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবন 

আমাদের দেশে গ্যাস্ট্রিকের জন্য ওষুধ সেবন একটি সিস্টেম হয়ে গিয়েছে। সামান্য গ্যাস হলেই আমরা ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া মুড়ি-মুড়কির মতো গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেয়ে থাকি। যার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। সব ওষুধেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া আর দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবন করলে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়। আর বছরের পর বছর ধরে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবন করলে পিত্তথলিতে পাথর হবার সম্ভবনা থাকে।

মানসিক চাপ 

মানসিক চাপ যেকোনো রোগেরই মূল কারণ। যারা অধিক মাত্রায় মানসিক চাপে ভোগেন তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে খুব বেশি রোগের স্বীকার হয়৷ কাজের স্ট্রেস শরীরের সবকিছু ইমব্যালেন্স করে। যতটা সম্ভব তাই মানসিক চাপমুক্ত থাকা জরুরি। দীর্ঘদিন ধরে অতিমাত্রায় মানসিক চাপে থাকলে তার প্রভাব পড়ে গলব্লাডারে। আর সৃষ্টি হয় গলব্লাডারে স্টোন।

পিত্তথলিতে বারবার ইনফেকশন

সাধারণত পিত্তথলির পাথর পুরুষের তুলনায় নারীদের বেশি হয়ে থাকে। তবে উভয়েরই এ রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভবনা আছে। পিত্তথলির পাথর হবার অন্যতম আরও একটি কারণ হলো বারবার পিত্তথলির ইনফেকশন। যাদের পিত্তথলির ইনফেকশন নিমূল হয় না বা বারবার হয় তাদের খুব বেশি চান্স থাকে এ রোগের। তাই সময় থাকতে তাদের সচেতন হওয়া উচিত।

দেহে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি থাকলে

যাদের দেহে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি তাদের পিত্তথলির পাথর হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সাধারণত শরীরে টোটাল কোলেস্টেরল এর পরিমাণ অধিক মাত্রায় থাকলে হার্ট ব্লকের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে৷ তাই অধিক কোলেস্টেরল থাকলে পিত্তথলির পাথর আছে কি না সেটা দেখে নেওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে আপনি হোল এ্যাবডোমিনাল আল্ট্রাসাউন্ড করলেই বুঝতে পারবেন আপনার পিত্তথলিতে পাথর আছে কি না।

খাদ্যাভ্যাস 

খাদ্য যেকোনো রোগেরই নিয়ামক আবার যেকোনো রোগ ডেকে আনে। সঠিক খাদ্য সম্পর্কে তাই জানা উচিত এবং মেনে চলা উচিত। সুষম খাদ্য গ্রহণের অভাবে আজকাল অনেক রোগের উদয় হচ্ছে। ডায়াবেটিস, প্রেশার, হার্টের সমস্যাসহ আরও জটিল রোগ। যারা নিয়মিত তেল-চর্বিযুক্ত বা অতিরিক্ত মশলাযুক্ত খাবার গ্রহণ করেন তাদের পিত্তথলিতে পাথর হবার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।

অধিক ওজন 

খাদ্যের লাগামহীনতা ও হরমোনাল ইমব্যালেন্সের কারণে মানুষ ওবিসিটিতে ভোগে। যা সর্ব রোগের কারণ। অধিক ওজন থাকলে আপনার পিত্তথলির পাথর হবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। তাই অধিক ওজন হলে ওজন কমানো উচিত।

চিনি ও ক্যাফিন

চিনির কেনো উপকারিতা নেই, বরং এটি আমাদের শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। খাবারের সব ধরণের চিনি থেকে হতে পারে পিত্তথলির পাথর। আবার ক্যাফিনও এদিক থেকে পিছিয়ে নেই। যারা অতিরিক্ত চা, কফি পান করেন তাদেরও হতে পারে এ রোগ। তাই চিনি ও ক্যাফিন সমৃদ্ধ খাবারে পিত্তথলির পাথর হতে পারে।

গর্ভাবস্থায়

গর্ভাবস্থায় হরমোনের ওঠা-নামা অনেক বেশি হয়। এ সময় অনেক বেশি সমস্যা হয়। শরীরে আসে অনেক পরিবর্তন, যার রেশ অনেকক্ষেত্রে পরবর্তী সময়েও থেকে যায়। এসময় চলা-ফেরার পরিমাণ অনেক কমে যায়৷ গর্ভাবস্থায় নারীদের গলব্লাডারে পাথর জমার প্রবনতাও বাড়ে।

পারিবারিক সূত্রে

পারিবারিক বা বংশগত রোগে অনেকেই ভুগে থাকেন। অনেক রোগই আছে যেগুলো পারিবারিক সূত্রে পাওয়া। তাই পরিবারে কোনো সদস্যের যদি গলব্লাডারে পাথর থাকে তবে অন্য সদস্যদেরও হবার প্রবণতা বেড়ে যায়। বিশেষ করে বাবা, মা, ভাই, বোনের থাকলে এ রোগ হতে পারে।

পিওথলির পাথর হবার উপসর্গ

প্রতিটি রোগেরই লক্ষণ বা উপসর্গ থাকে। তবে অনেক রোগে শেষের দিকে উপসর্গ বোঝা যায়৷ পিত্তথলিতে পাথর হলেও এর কিছু উপসর্গ থাকে। এছাড়া চিকিৎসক পরবর্তী ধাপে উপসর্গ অনুসারে বিভিন্ন পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে থাকেন। পিত্তথলির পাথর হবার উপসর্গগুলো হলো-

  • পিত্তথলিতে পাথর হলে এতে প্রদাহ হয়।
  • পেটের ডানদিকে তীব্র ব্যথা হতে পারে। এই ব্যথা মিনিট খানেক থেকে ঘণ্টাখানেক স্থায়ী হতে পারে।
  • পাথর অনেক সময় পিত্তথলি থেকে বের হতে গিয়ে পিত্তনালিতে আটকে যায়। এতে অনেক সময় বিলিরুবিনের বিপাক ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে জন্ডিসও হতে পারে।
  • পেটে ব্যথার সময় বমি বমি ভাব হতে পারে।
  • হজমে সমস্যা হতে পারে।

পিওথলির পাথরের চিকিৎসা

পিত্তথলির পাথরের ক্ষেত্রে প্রদাহ ও তীব্র ব্যথার সময় কোনো অস্ত্রোপচার করা হয় না। এ অবস্থায় সাধারণত কয়েক দিনের জন্য মুখে খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করা হয়। প্রাথমিক উপশমের জন্য এ সময় স্যালাইন, অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যথানাশক ওষুধ দেওয়া হয়।

কারণ সপ্তাহ দুয়েক পর বা দু-তিন মাস পর অপারেশন করা যায়, তবে ব্যথা কমানো মূল বিষয়। পিত্তথলিতে পাথর হলে অপারেশন করা ছাড়া এর নির্মূলের উপায় নেই। সাধারণত পেট কেটে বা ছিদ্র করে এই অস্ত্রোপচার করা হয়। তবে এক্ষেত্রে পিত্তনালিতে পাথর আটকে গিয়ে থাকলে ইআরসিপি যন্ত্রের সাহায্যে পাথর বের করে আনা হয়।

বর্তমান সময়ে পেট কেটে অপারেশন করার চেয়ে পিত্তথলির পাথর নিরাময়ের জন্য ল্যাপারস্কোপির পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। তবে তা রোগীর ধরণের উপর নির্ভর করে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে ল্যাপারস্কোপি খুবই সুবিধাজনক অপারেশন পদ্ধতি।

এ পদ্ধতিতে পেট না কেটে শুধুমাত্র ছোট ছিদ্র করে ক্যামেরার সাহায্যে অপারেশন করা হয়। পিত্তথলি পেটের যে অংশে অবস্থিত সেখানে ছোট ছোট ছিদ্র করে সূক্ষ্ম সরু যন্ত্র দিয়ে পিত্তথলির পাথর অপসারণ করা হয়। এই অপারেশনের পর ব্যথা ও রক্তক্ষরণ কম হয়ে থাকে। রোগী ১-২ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে বাসায় যেতে যায়।

অপারেশন পরবর্তী নিয়ম

পিত্তথলির পাথর অপারেশনের পর রোগীকে অবশ্যই কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। রোগী সুস্থ হতে একটু সময় লাগবে। সার্জারির পর এবং পরবর্তী সময়ে কিছু নিয়ম মেনে চললে আজীবন সুস্থ থাকা সম্ভব।  যেমন-

  • লো-ক্যালরিযুক্ত খাবার গ্রহণ।
  • তেল-চর্বিযুক্ত খাবার বর্জন।
  • ফাইবার সমৃদ্ধি খাবার গ্রহণ। যেমন- ব্রাউন রাইস, লাল আটা, আঁশযুক্ত সবজি ইত্যাদি।
  • নিয়মিত ঘুমানো, ব্যায়াম করা ও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।
  • ফাস্টফুড, সল্টি খাবার এড়িয়ে চলা।

উপসংহার

পিত্তথলির পাথর পিত্তশয়ের একটি রোগ। এটি ৮০% এর বেশি ক্ষেত্রে কোনো প্রকার জটিলতা সৃষ্টি করে না। তবে এ রোগে অপারেশন প্রয়োজন হয়৷ যদিও উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে অপারেশন পদ্ধতিও আজকাল সহজ হয়েছে। সুতরাং এ রোগ নিয়ে ভয়ের কোনো কারণ নেই৷ শুধুমাত্র সচেতন থাকা উচিত। আর কোনো ব্যক্তির অপারেশন হলে অবশ্যই সঠিক নিময় মেনে জীবনযাত্রার পরিবর্তন ঘটালেই সুস্থ থাকা সম্ভব। 

আপনার মনে কোন প্রশ্ন থাকলে এখানে ক্লিক করুন!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top