গ্যাস্ট্রোলিভার রোগের লক্ষণ

গ্যাস্ট্রোলিভার রোগের লক্ষণ কী? জানুন এর প্রতিরোধ ও প্রতিকার!

মানুষের শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ অঙ্গ হলো লিভার। প্রায় ৫০০ ধরনের বেশি কাজ করে এটি আমাদের শরীরকে সচল রাখতে সাহায্য করে৷ তাই এর গঠনশৈলীও অন্যান্য অঙ্গের তুলনায় বেশ জটিল।

বিভিন্ন কারণে লিভার রোগে আক্রান্ত হতে পারে। লিভারের এই রোগ ও সমস্যা আক্রান্ত হওয়াকে গ্যাস্ট্রোলিভার বলো। দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ গ্যাস্ট্রোলিভারে আক্রান্ত। 

তবুও আমরা অনেকেই এই রোগের লক্ষণ সম্পর্কে জানিনা। এজন্যে সঠিক সময়ে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হই। তাই গ্যাস্ট্রোলিভার রোগের লক্ষণ জানার মাধ্যমে আমরা আজ এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করবো। 

গ্যাস্ট্রোলিভার রোগের লক্ষণ

গ্যাস্ট্রোলিভার একটি শরীরে নীরবঘাতী রোগ। যেকোনো এই রোগ ধরা পড়তে পারে৷ তাই গ্যাস্ট্রোলিভার রোগের লক্ষণ সম্পর্কে আগাম জেনে রাখতে হবে। আসুন জেনে নিই লক্ষণগুলো কী কী। 

১. চোখ হলদেটে হয়

হলুদ চোখ গ্যাস্ট্রোলিভার রোগের লক্ষণ। আমাদের লিভার বিকল হলে বা কাজ না করলে বিলিরুবিন নামক হলুদ রঙয়ের একটি পদার্থ লিভার থেকে নিঃসরিত হয়। ফলে শরীরে বিলিরুবিন পুঞ্জিভূত হতে থাকে। যার প্রভাব আমাদের শরীরে দেখা যায়। এতে চোখের সাদা অংশ হলদে দেখায়। এছাড়া এতে আমাদের শরীর ও মূত্র হলুদ হতে পারে।

২. পেট ফুলে উঠা

পেট ফুলে উঠাও লিভার সমস্যার একটি লক্ষণ। লিভারে সমস্যা হলে রক্ত প্রবাহ বাঁধা পায়। এর ফলে চারপাশের রক্তনালিতে চাপ বাড়ে। এই বর্ধিত চাপের কারণে পেটের ভেতর তরল, গ্যাস ও খাবার জমা হয়। যা পেটকে ফুলিয়ে তোলে। 

আপনার পেট যদি হঠাৎ ফুলে যায় এবং তা যদি না কমে, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। 

৩. চুলকানি

অসুস্থ লিভার শরীরের সর্বত্র চুলকানির উদ্রেক করতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী লিভারের সমস্যায় ভুগলে ত্বকে এমন চুলকানি অনুভূত হয়। বাইল সল্ট বা পিত্ত লবণের জন্য এই চুলকানি হয়ে থাকে। 

পিত্ত লবণ হচ্ছে লিভার দ্বারা উৎপাদিত পাচন পদার্থ। লিভার রোগে আক্রান্তদের এই পিত্ত লবণ লিভারে জমা হতে থাকে এবং শরীরে চুলকানি সৃষ্টি করে। ত্বকে ফুসকুড়ি না থাকলেও শরীর চুলকাতে পারে।

[বিঃ দ্রঃ লিভার অসুখের চুলকানি, চুলকানির ওষুধ দ্বারাও কমানো যায় না।]

৪. ক্লান্তিভাব

লিভার রোগে আক্রান্ত অনেকেই দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তিতে ভোগেন। কারণ এসময় শরীর অতিরিক্ত টক্সিন তৈরি করে। ফলে শরীরে ক্লান্তিভাব ও দূর্বলতা পরিলক্ষিত হয়। 

এছাড়াও আক্রান্ত লিভার শরীর ও রক্তে বিষাক্ত পদার্থ নিঃস্বরণ করে। এতে মস্তিষ্কের কার্যকারিতায় ব্যাঘাত ঘটে। এসময় ঘুমঘুম ভাব আসে এবং শরীর ক্লান্তি অনুভব করে।

৫. শারীরিক পরিবর্তন 

লিভার রোগে আক্রান্ত হলে শারীরিক অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। অনেকেরই হাত ও পায়ের গোড়ালি ফুলে যায় এবং পায়ে তরল জমা হয়। এছাড়া নাক দিয়ে রক্তপাত হতে পারে। ত্বকের নিচে রক্তনালিগুলো দেখা যাবে। কিংবা রক্তনালিগুলো মাকড়সার জালের মতো লালচে হয়ে উঠতে পারে। 

এই লক্ষণগুলো প্রায়শই গাল, নাক ও ঘাড়ে দেখা যায়। এমনকি হাতের তালুতেও এই দাগ দেখা দিতে পারে। এমন লক্ষণ দেখলেই বুঝতে হবে লিভারের সমস্যা গুরুতর হয়ে উঠেছে। এসময় চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অতীব জরুরি।

৬. ত্বকে পরিবর্তন 

অতিরিক্ত ঘাম বের হওয়া লিভার রোগের আরেকটি লক্ষণ। লিভারের কার্যক্ষমতা কমে গেলে সেটি উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। তখন সে উত্তাপ দেহের অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে যায়। এবং অতিরিক্ত ঘাম বের হবার মধ্য দিয়ে শরীর নিজেকে ঠান্ডা করে। 

এছাড়া লিভারে চর্বি জমা হলে অতিরিক্ত চর্বি দেহে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। যা থেকে ত্বকে অতিরিক্ত ব্রণ সৃষ্টি হয়। এমনকি শরীরেও ব্রণ সৃষ্টি হতে পারে।

৭. অতিরিক্ত ওজন

লিভার মূলত চর্বি হজমের কাজ করে থাকে। কিন্তু লিভার রোগে আক্রান্ত হলে চর্বি হজমের কাজ ঠিকমতো করতে পারে না। তখন চর্বিগুলো অন্ত্র থেকে লিভারে এসে জমা হয়। ফলে দেহে চর্বি জমা শুরু হয় এবং ওজন হঠাৎ বেড়ে যায়। 

লিভার ভালো রাখা উপায়

লিভার সমস্যার জন্য দায়ী আমাদের জীবনযাত্রা। প্রতিদিনের খাবারে বেশি তেল মশলা, অতিরিক্ত ধূমপান, সফট ড্রিঙ্ক, চকোলেট, আইসক্রিম, অ্যালকোহল, বেকারির খাবার, তেলেভাজা, কাঁচা লবণ আমাদের লিভারে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত করে। 

এছাড়াও অনেকেই অনিয়মিতভাবে খাবার খান। খাবারে দীর্ঘক্ষণ গ্যাপ পড়লে লিভারের সমস্যা দেখা দেয়। লিভারের সমস্যা হলে খাবার হজম হয় না। এতে গ্যাস, অম্বল, পেটব্যথা এসব লেগেই থাকে। এছাড়াও মেটাবলিজম  খারাপ হয়ে যায়। তাই লিভারের ভালো রাখতে যে সমস্ত খাবার খাবেন তা নীচে তুলে ধরা হলো। 

কফি

হ্যা ঠিক পড়ছেন, কফি আমাদের লিভারের জন্য অনেক উপকারী উপাদান। এটি দীর্ঘস্থায়ী লিভারের রোগ যেমন সিরোসিস, এমনকি লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি কমিয়ে দিতে পারে।

কফিতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট লিভারকে জ্বালা ও প্রদাহের হাত থেকেও রক্ষা করে। সেই সঙ্গে লিভারের ফ্যাটসহ যে কোনও সমস্যার জন্য এটি খুবই ভালো।

তবে কফি খেতে হবে দুধ ও চিনি ছাড়া। একেবারে কালো কফি লিভারের জন্য বেশ ভালো। 

রসুন

লিভার ভালো রাখার জন্য উত্তম খাবার হল রসুন। রসুনে থাকা এনজাইম উপাদান লিভারের ক্ষতিকর টক্সিক উপাদান পরিষ্কার করে। এছাড়াও রসুনে বিদ্যমান এলিসিন এবং সেলেনিয়াম লিভার থেকে ক্ষতিকর পদার্থ বের করে লিভারকে ঠান্ডা রাখে। 

তাই প্রতিদিন যে কোন সময় ১/২ টি রসুনের কোয়া খেতে পারেন। এমনকি আপনি ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে রসুনের তৈরি ভিটামিনও খেতে পারেন।

লেবু পানি 

লেবুতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান দেহের লিভার পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। লেবুর ডি লিমনেন উপাদান লিভারে এনজাইম সক্রিয় করে। তাছাড়া লেবুর ভিটামিন সি লিভারে বেশি করে এনজাইম তৈরি করে। যা হজম শক্তি এবং লিভার দূষণ মুক্ত রাখতে সাহায্য করে। 

লেবুতে রয়েছে মিনারেল উপাদান, যা লিভারকে শোষণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তাই বাসায় প্রতিদিন লেবুপানি পান করুন। 

লেবুপানি যেকোনো সময় খেতে পারেন তবে সকালে খালি পেটে খাওয়া উত্তম। প্রতিদিন লেবুপানির সাথে মধু মিশিয়েও খেতে পারেন। এতে উপকার বেশি। 

আপেল

আপেলে থাকা পেক্টিন, ফাইবার দেহের পরিপাকনালী হতে টক্সিন ও রক্ত হতে কোলেস্টেরল দূর করে। ফলে আমাদের লিভারকে সুস্থ থাকে। আপেলে আছে ম্যালিক এসিড যা প্রাকৃতিক ভাবেই রক্ত হতে ক্ষতিকর টক্সিন দূর করে। তাই লিভারের জন্য যেকোন ধরণের আপেলই ভালো। 

অলিভ ওয়েল

আমাদের দেশে খাবারের জন্য অলিভ ওয়েল প্রচলিত না। তবে এটি লিভার ভালো রাখার জন্য অনেক উপকারী। এতে রয়েছে ফ্যাটি অ্যাসিড যেটি লিভার ও শরীরের জন্য অনেক উপকারী।

তাই লিভার ভালো রাখতে অলিভ অয়েলের তৈরি খাবার খান। এতে লিভারের পাশাপাশি হার্টও ভালো থাকে। 

পানি

পানি আমাদের কাছে অনেক সাধারণ মনে হলেও এটি আমাদের শরীর এবং লিভার ভালো রাখার জন্য অনেক উপকারী। বিশেষ করে এটি লিভারের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পানি খাবারকে হজম করতে সাহায্য করে সেইসাথে লিভারের অভ্যন্তরীণ কাজে সহায়তা করে। 

লিভারের চিকিৎসা; লিভার প্রতিস্থাপন

বর্তমানে লিভার চিকিৎসার জনপ্রিয় পদ্ধতি হয়ে উঠেছে লিভার প্রতিস্থাপন। লিভার প্রতিস্থাপন হল এমন একটি সার্জারি অপারেশন যার মাধ্যমে অসুস্থ লিভারকে সরিয়ে তার জায়গায় সুস্থ লিভার স্থাপন করা হয়। 

লিভার যখন পর্যাপ্ত ভাবে কাজ করতে পারে না তখন বিশেষজ্ঞরা লিভার প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। লিভার প্রতিস্থাপন করা হয় মূলত সিরোসিস, হেপাটাইটিস, লিভার ক্যানসার ও কোনো বংশগত লিভারের রোগ হলে।

লিভার প্রতিস্থাপন অপারেশন করতে সাধারণত ৪-১২ ঘণ্টা লাগে। এরপর রোগির অবস্থার উপর বিবেচনা করে ১৪-২১ দিন হাসপাতালে থাকতে হয়। কেউ কেউ ৭ দিনেও বাসায় ফিরে।

উপসংহার 

গ্যাস্ট্রোলিভার পৃথিবীর প্রাণঘাতী রোগগুলোর মধ্যে একটি। এটি খুব ধীরে ধীরে মানবদেহের ক্ষতি সাধন করে। তাই একে নীরব ঘাতকও বলা হয়। অবস্থা খুব বেশি জটিল না হলে সাধারণত এর লক্ষণ ভালোভাবে প্রকাশ পায়না। কিন্তু ততক্ষণে রোগীর মৃত্যু অবধারিত হয়ে যায়। 

তাই গ্যাস্ট্রোলিভার রোগের লক্ষণ অনুসন্ধান করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। যেকোনো পরামর্শ ও আয়ুর্বেদ ওষুধের জন্য যোগাযোগ করুন @হেলদিস্পোর্টস.কম। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top
Scroll to Top