জলাতঙ্ক রোগ

জলাতঙ্ক রোগ কী? এর লক্ষণ ও প্রতিকার সহ বিস্তারিত জানুন!

জলাতঙ্ক রোগ প্রাচীন রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রাণিবাহিত র‍্যাবিস ভাইরাসঘটিত জলাতঙ্ক খুবই ভয়াবহ একটি রোগ। একে হাইড্রোফোবিয়া কিংবা পাগলা রোগও বলা হয়ে থাকে। এই রোগে আক্রান্ত রোগী পানি দেখলে বা পানির কথা মনে পড়লে প্রচণ্ড আতঙ্কিত হয়ে পড়ে বলে এই রোগের নাম জলাতঙ্ক। 

আক্রান্ত ব্যক্তির এই লক্ষণ দেখা দিলে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা নিতে হবে। চলুন জলাতঙ্ক রোগ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত কিছু তথা জেনে নেওয়া যাক। 

জলাতঙ্ক রোগ কী?

জলাতঙ্ক হলো প্রাণী থেকে মানব শরীরে সংক্রমক একটি ভাইরাস জনিত রোগ৷ এই রোগের মূল কারণ র‌্যাবডো (র‌্যাবিস) ভাইরাস, যা লিসা ভাইরাস গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। গৃহপালিত পশু বা পোষ্যপ্রাণী বা বন্য প্রাণী থেকে পরবর্তীতে মানুষ আক্রান্ত হয় এবং এ রোগের বিস্তার ঘটে। 

সাধারণত দুই ধরণের জলাতঙ্ক রোগ দেখা যায়-ফিউরিয়াস ও প্যারালাইটিক। ফিউরিয়াস ধরণটি সংক্রামিত জলাতঙ্ক রোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এটি একটি মারাত্মক রোগ। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ জলাতঙ্কে মারা যান। তবে বাংলাদেশেও এ রোগের প্রভাব একদম কম নয়। প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ৪০-৫০ জন মানুষ জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ২৫ হাজার গবাদিপশুও এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। 

মাবন দেহে জলাতঙ্ক রোগ যেভাবে ছড়ায়

জলাতঙ্ক ভাইরাস স্তন্যপায়ী প্রাণীর স্নায়ুতন্ত্রে ছড়িয়ে পড়ে। জলাতঙ্কে আক্রান্ত প্রাণীর আঁচড়ে বা কামড়ে মূলত মানুষের শরীরে এ রোগ প্রবেশ করে। সাধারণত গৃহপালিত প্রাণী ও বন্য প্রাণীরা প্রথমে সংক্রমিত হয় এবং পরে মানুষ যদি সংক্রমিত এসব প্রাণী বা এদের লালার সংস্পর্শে আসে বা এই প্রাণীগুলি যদি মানুষকে কামড়ায় অথবা আঁচড় দেয় তাহলে রক্তের মাধ্যমে র‍্যাবডো ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে যার ফলে মানুষ আক্রান্ত হয় এবং মানুষের মধ্যে এ রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। 

উষ্ণ রক্ত বিশিষ্ট প্রজাতি এমনকি মানুষ জলাতঙ্ক ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারে এবং এই ভাইরাস শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণীর কোষেও বর্ধিত হতে পারে। বেশির ভাগ প্রাণীই ভাইরাসে সংক্রমিত হয় এবং সহজেই রোগটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। 

বাদুড়, বানর, শিয়াল, গরু, নেকড়ে বাঘ, কুকুর, নকুল এবং বিড়ালের মাধ্যমে সাধারণত এ রোগ বেশি ছড়িয়ে পড়ে। যাদের গৃহপালিত পশু রয়েছে বা পোষ্যপ্রাণী রয়েছে তাদেরও আক্রান্ত হবার সম্ভবনা থাকে। 

সংক্রমিত প্রাণী অনেকসময় ব্যতিক্রমধর্মী আক্রমণপ্রবণ হয়ে থাকে এবং বিনা উসকানিতেই আক্রমণ করে থাকে যা প্রাণীর আচরণের অস্বাভাবিকতাকে নির্দেশ করে। তবে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ খুবই কম হয়ে থাকে। অনেকসময় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করলে,  সংক্রমিত ব্যক্তির কামড়ে, নখের আঁচড়ে, যৌনমিলনের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। 

জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ

জলাতঙ্কে সংক্রমিত প্রাণী কামড়ানোর  ৯-৯০ দিনের মধ্যে লক্ষণ দেখা দেয়। যা ধীরে ধীরে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে প্রকাশ পায়। যেমন- 

  • প্রাণীর কামড় বা আঁচড়ে আক্রান্ত হলে ক্ষতস্থানে চুলকানো।
  • ২-৪ দিন ধরে জ্বর।
  • মাথাব্যাথা ও মাংসপেশিতে ব্যাথা।
  • পানিভীতি বা Hydrophobia যা এ রোগের অন্যতম একটি বড় লক্ষণ।
  • ব্যক্তি উচ্চ শব্দ, বাতাস বা উজ্জ্বল আলো সহ্য করতে পারে না। আলো-বাতাসের সংস্পর্শে এলে আতঙ্ক বৃদ্ধি পায়।
  • চেহারা ও ভাব-ভঙ্গিতে ও কথাবার্তায় অস্বাভাবিকতা থাকে।
  • অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখায় সববিষয়ে।
  • ক্ষুধামন্দা ও খাওয়াতে অরুচি।
  • খাবার খেতে কষ্ট হয় ও খেতেও পারে না।
  • কন্ঠস্বরের পরিবর্তন আসে এবং কর্কশ হয়ে যায়। 
  • আওয়াজ বিকৃত হয়ে যায়। 
  • মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়।
  • অনেক সময় অন্যকে কামড় দেবার প্রবণতা কাজ করে।
  • আক্রান্ত ব্যক্তির পানি পিপাসা খুব বেড়ে যায় তবে পানি খেতে পারেনা। 
  • অনেক সময় উন্মাদ হয়ে যায়।
  • মুখ দিয়ে অতিরিক্ত লালা নিঃসরণ হবে, শরীরে কাঁপুনি আসে।
  • শরীর নিস্তেজ হয়ে ঝিমুনি আসতে পারে।
  • আক্রান্ত স্থানে অবশ লাগতে পারে ও অসাড়তা অনুভূত হয়।
  • শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ু দুর্বল হয়ে যাবার ফলে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।
  • ব্যক্তির পক্ষাঘাত হতে পারে। 
  • শেষের দিকে খিঁচুনি দেখা দিতে পারে।

জলাতঙ্ক রোগ সনাক্তকরণ

প্রাথমিক অবস্থায় জলাতঙ্ক রোগ নির্ণয় করা বেশ  কঠিন ও অনেক সময় লাগতে পারে কারণ অন্যান্য রোগের সাথে এর সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। রেবিস অ্যান্টিজেন সনাক্তকরণের জন্য ইমিউনোফ্লোরেসেন্স নামক একটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতিতে ত্বকের একটি ছোট টিস্যু ব্যবহার করা হয়। আবার সংক্রামিত রোগীর লালা থেকে ভাইরাসটি আলাদা করে রোগ সনাক্তকরণ করা হয়।

জলাতঙ্কে আক্রান্ত প্রাণীর আক্রমণে করণীয়

জলাতঙ্কে আক্রান্ত প্রাণীর আক্রমণে করণীয় পদক্ষেপসমূহ হলো:

যে কাজগুলো করা উচিত

  • জলাতঙ্ক আক্রান্ত প্রাণীর আক্রমণের পর অবশ্যই খেয়াল করুন আপনি কতটা আহত হয়েছেন কারণ এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিড়ালের আঁচড় চামড়ার উপরিভাগে থাকে বিধায় রক্ত গড়িয়ে পড়ে না আবার গভীরে  ক্ষত সৃষ্টি করে। তবে কুকুরে কামড়ালে রক্ত বের হয়। শুরুতেই আক্রান্ত স্থানে ক্ষত ও রক্তপাতের তীব্রতা খেয়াল করতে হবে ও প্রাথমিক অবস্থায় ক্ষতস্থান চেপে ধরতে হবে যেনো দ্রুত রক্তপাত বন্ধ হয়ে যায়।
  • আক্রান্ত প্রাণী আঁচড় বা কামড় দিলে টিউবওয়েলের পানি দিয়ে ন্যূনতম ১৫/২০ মিনিট ধরে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে হবে এতে ৭০-৮০ শতাংশ জীবাণু মারা যায়। র‍্যাবিস ভাইরাস প্রতিরোধে সাবান পানি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই সম্ভব হলে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল সাবানও ব্যবহার করতে হবে কারণ এটি ভাইরাসসহ ক্ষতে অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া ও জীবাণু ধ্বংস করতে সাহায্য করবে।
  • ক্ষতস্থানটিকে ভালো করে পরিষ্কার করতে ১০ সেকেন্ড ধরে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড সলিশন বা আয়োডিন সলিউশন ব্যবহার করতে হবে ফলে অর্ধেকের বেশি ভাইরাস নষ্ট হয়ে যায়। খুব বেশি রক্তপাত হলে সাময়িকভাবে জীবাণুমুক্ত গজ কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজ করেতে হবে তবে ক্ষতস্থানে কোনো সেলাই দেওয়া যাবে না।
  • ক্ষতস্থান নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে যেনো কাটা স্থানে ধুলাবালি ও ময়লা না লাগে। তবে ক্ষতস্থান যদি ফুলে যায়, লাল হয়ে যায়, তীব্র ব্যথা করে, ওই স্থান থেকে ক্রমাগত বিরামহীনভাবে রক্ত চুঁইয়ে পড়ে, জ্বর আসে তবে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

যে কাজগুলো করা অনুচিত

  • ক্ষতস্থানে কোনো প্রকার বরফ, চিনি, সেলাইন, লবণ ইত্যাদি ক্ষারক পদার্থ ব্যবহার করা যাবে না।
  • ঝাড়ফুঁক, বাটিপড়া, পানপড়া, চিনিপড়া, মিছরিপড়া, ইত্যাদি অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতির শরণাপন্ন হওয়া অনুচিত।
  • মাটি, কয়লা, তেল, চক লাগাবেন না।
  • ক্ষতস্থান কখনোই ছুরি বা অন্য কিছু দিয়ে কাটা, চোষন, পোড়ানো যাবে না। এতে ইনফেকশন হতে পারে।
  • ক্ষতস্থানে ইলেকট্রিক শক দেওয়া যাবে না। 
  • ব্যক্তির হাত-পা বাঁধা যাবে না।
সবধরনের অর্গানিক ফুড, ২০০+ আয়ুর্বেদ ঔষধ ও খেলার সামগ্রী ঘরে বসেই অর্ডার করুন হেলদি-স্পোর্টস শপ থেকে- https://shop.healthd-sports.com

জলাতঙ্ক রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা ও প্রতিষেধক

এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার অ্যান্টিভাইরাল ঔষধ কাজ করতে পারে না। শুধুমাত্র  উপশমমূলক চিকিৎসা এক্ষেত্র প্রদান করা সম্ভব। তবে পুরাতন এই রোগের টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। আশার কথা এই যে, রেবিড প্রাণী কামড় দেওয়ার সাথে সাথে দ্রুত সময়ের মধ্যে টিকা নিলে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। 

জলাতঙ্কের দুই ধরনের টিকা রয়েছে। একধরনের টিকা মাংসপেশিতে (শুধু বাহুতে) এবং অন্যটি চামড়ায় দিতে হয়। আক্রান্ত হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে অথবা নিকটবর্তী হাসপাতালে নিতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো র‍্যাবিস ভ্যাকসিন নিতে হবে। সাধারণত প্রথম দিন দেওয়ার পর ৩, ৭, ১৪ ও ২৮তম দিনে ভ্যাকসিন দিতে হয়। সর্বমোট ৬টি ডোজে ভ্যাকসিন দিতে হয়। নাভির চারপাশে চামড়ার নিচে এ টিকা নেওয়া হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ানুযায়ী  সবগুলো ডোজ গ্রহণের মধ্যমে টিকার কোর্স সম্পন্ন করা আবশ্যক। পশুচিকিৎসক, চিড়িয়াখানার প্রাণীদের দেখাশোনাকারী, যারা বাড়িতে কুকুর বা বিড়াল পোষেন, তাদের জলাতঙ্কের প্রতিরোধমূলক টিকা দেওয়া হয়।  ০, ৭ ও ২১ বা ২৮তম দিনে টিকার তিনটি ডোজ ও প্রতিবছর বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়।

জলাতঙ্ক রোগ হলে যে বিষয়গুলো জেনে রাখা জরুরি

অবশ্যই জলাতঙ্ক রোগ হলে নীচের বিষয়গুলি অনুসরণ করবেন। 

  • উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ দেশের ৬৩টি জেলা সদরে অবস্থিত হাসপাতালের জরুরি বিভাগে বিনা মূল্যে জলাতঙ্কের এই টিকা প্রদান করা হয়।
  • গর্ভবতী, ব্রেস্টফিডিং মায়েদের জন্য জলাতঙ্কের টিকা নিরাপদ।
  • টিকা দিতে ব্যথা খুব একটা লাগে না।

জলাতঙ্ক রোগে সতর্কতা

জলাতঙ্ক রোগ হলে অবশ্যই নিম্নোক্ত সতর্কতাগুলি মেনে চলতে হবে। 

  • সেবাদানকারীকে টিকা দিতে হবে।
  • লক্ষণ দেখা দেবার আগেই চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।
  • আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির মরদেহ মাটিতে পুঁতে দিতে হবে।
  • আক্রান্ত ব্যক্তির প্লেটে খাবার খাওয়া যাবে না।

পরিশেষে বলা যায়, জলাতঙ্ক রোগ একটি ভয়াবহ রোগের নাম, যা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে। তবে এখন আতঙ্কের দিন শেষ। শুধুমাত্র সচেতনতা, যথাযথ পদক্ষেপ, সঠিক চিকিৎসা ও টিকা পারে এই রোগ প্রতিরোধ করতে।

আপনার মনে কোন প্রশ্ন থাকলে এখানে করুন!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top
Scroll to Top