হেপাটাইটিস বি

হেপাটাইটিস বি (Hepatitis B) কি ও কেন? এর প্রতিরোধের উপায়!

হেপাটাইটিস বি একটি মারাত্মক সংক্রামক রোগ। এটি মূলত লিভারের  প্রদাহ। ভাইরাল হেপাটাইটিসের মধ্যে এটি অন্যতম। বড়রা  এই রোগ থেকে সহজে সুস্থ হলেও ,শিশুদের এই অসুখ সহজে ছাড়েনা। 

অনেকের ক্ষেত্রে এই রোগের সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী হয়।  সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করলে যকৃতের কার্যক্ষমতা হ্রাস,যকৃতের ক্যান্সার অথবা সিরোসিসও হতে পারে।

বর্তমানে এই রোগটি এইচআইভি এইডসের চাইতেও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এইডসের চাইতেও এই অসুখটি ছড়িয়ে যায় খুব দ্রুত। 

হেপাটাইটিস বি কি?

এটি একটি মারাত্মক সংক্রামক রোগ। হেপাটাইটিস বি ভাইরাস এই রোগের জন্য দায়ী। এই অসুখ যকৃতে মারাত্মক সংক্রমণ ঘটায়। রক্ত, বীর্য অথবা শরীরের অন্যান্য তরল পদার্থের মাধ্যমে এই ভাইরাস সুস্থ ব্যাক্তির দেহে প্রবেশ করে। বড়রা এই অসুখ থেকে সুস্থ হলেও ,শিশুদের ক্ষেত্রে সংক্রমণ থেকেই যায়। 

বর্তমান বিশ্বে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকারক ভাইরাস হিসেবে ধরা হয় “হেপাটাইটিস” রোগকে। এই ভাইরাস  লিভারে প্রদাহের সৃষ্টি করে । সময়মতো চিকিৎসা না করানো হলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। 

বাংলাদেশে প্রায় শতকরা ৭ ভাগ মানুষ এই ভাইরাস বহন করছে। তারা বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ জটিল লিভারের রোগ এ ভুগে থাকেন। বাংলাদেশের  প্রায় ৩.৫% গর্ভবর্তী মায়েরা এই ভাইরাসে আক্রান্ত। এই ভাইরাস তাদের নবজাতকের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। এই ভাইরাসটি এইডস রোগের চেয়ে ১০০ ভাগ বেশী সংক্রামক। দিন দিন এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। 

সংক্রমণের প্রকারভেদ 

হেপাটাইটিস বি-এর সংক্রমণ দু রকমের হয় । অ্যাকিউট বা তীব্র সংক্রমণ এবং ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ।

কোনও ব্যক্তি যখন প্রথম বার এই ভাইরাসে আক্রান্ত হন, তখন সেটিকে অ্যাকিউট হেপাটাইটিস বলে। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এই সংক্রমণ বেশি দেখা যায়। সঠিক চিকিৎসা নিলে রোগী তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যায়। 

এই ভাইরাসটিই আবার যখন দীর্ঘ সময় অর্থাৎ ছ’মাসেরও বেশি সময় ধরে রক্তে থাকে, তখনই ক্রনিক হয়ে যায়। শিশুরা এই ধরণের হেপাটাইটিসে বেশি ভুগে। 

ক্রনিক হেপাটাইটিস হলে  যকৃত ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক রোগীর অনেকসময় অ্যাকিউট অবস্থায় হেপাটাইটিস ধরাই পড়ে না। ফলে যখন তা ধরা পড়ে, তখন দেখা যায়, সেটি ক্রনিকে পরিণত হয়েছে। অনেকের লিভার সিরোসিস হওয়ার পর রোগ ধরা পড়ে। তবে সেই পরিস্থিতিতেও যদি ঠিক মতো চিকিৎসা হয়, তা হলে ধীরে ধীরে রোগী সুস্থ করা সম্ভব। তবে ক্রনিক হেপাটাইটিসের ক্ষেত্রে হেপাটোসেলুলার কার্সিনোমা (যকৃত ক্যানসার) হতে পারে। তবে, সেই সংখ্যা বর্তমানে কম।

হেপাটাইটিস বি এর লক্ষণ সমূহ – Hepatitis B Symptoms

হেপাটাইটিস বি কিভাবে ছড়ায়?

আক্রান্ত রোগীর রক্ত, বা লালা থেকেও এই রোগটি ছড়াতে পারে। কিন্তু এ ছাড়াও আরো বেশ কিছু মাধ্যমে এই রোগটি মানবদেহে বিস্তার ঘটায়। যেমন-

  • অনিরাপদ যৌনতা/অবাধ যৌনতা থেকে
  • একই সিরিঞ্জ, সুঁই বারবার ব্যবহার করলে
  • শরীরে উল্কি / ট্যাটু আঁকলে
  • স্যালুনে ব্যবহৃত ক্ষুর, রেজর, ব্লেড, কাঁচি হতে
  • হাসপাতালে হেপাটাইটিস বি আক্রান্তদের পরিচর্যার কারণে
  • ডেন্টিষ্টের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি থেকে
  • অপারেশন থিয়েটারে ব্যবহৃত(অনিরাপদ) যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কারণে , সিরিঞ্জ এ মাদক নিলে
  • রোগীর  সিগারেট থেকে 
  • রোগীর লালা, রক্ত, ভ্যাজাইনাল তরল থেকে 
  • আক্রান্ত মায়ের দুধ পান  করার ফলে নবজাতকের এই রোগ হতে পারে 
  • আক্রান্ত মায়ের  প্লাসেন্টা জরায়ু থেকে পৃথক হওয়ার সময়
  • আক্রান্ত মায়ের  অ্যামনিওসেনটেসিস করা হলে
  • নিরীক্ষাবিহীন রক্ত এবং রক্তের উপাদান পরিসঞ্চালন করলে 
  • সমকামী ও উভয়কামী হলে 
  • ব্যক্তিগত জিনিস  যেমন- টুথ ব্রাশ, রেজার একাধিক ব্যক্তি করলে। 

রোগীর সাথে সামাজিক মেলামেশা করলে কি রোগ ছড়ায় ?

সামাজিক মেলামেশায়  যেমন -হ্যান্ড শেক, কোলাকুলি করলে এই রোগ ছড়ায় না । রোগীর ব্যবহার্য দ্রব্যাদি যেমন- গ্লাস, চামচ, জামা কাপড়ের মাধ্যমেও এটি  ছড়ায় না।।

শুধুমাত্র যে সমস্ত দ্রব্য রোগীর রক্তের সংস্পর্শে আসে যেমন: ক্ষুর, ব্লেড, রেজার, টুথব্রাশ, সূচ এইসব ব্যবহার করলে এই অসুখ ছড়াতে পারে। 

হেপাটাইটিস বি রোগের  উপসর্গ

আক্রান্ত রোগীর অনেকসময় কোনো উপসর্গ প্রকাশ পায়না। এই রোগ রোগীর দেহে   প্রায় ৪ সপ্তাহ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত সুপ্তাবস্থায় (ভাইরাস সংক্রমন থেকে রোগের লক্ষণ পর্যন্ত)  থাকে। তবে অনেকসময় নিম্নের লক্ষণগুলো রোগীর মাঝে দেখা যায় , যেমন –

  • জ্বর কিংবা জ্বরজ্বর ভাব, 
  • রোগী অনেক সময় ক্লান্তিবোধ করে , 
  • রোগীর শরীর টনটন করে , 
  • অনেকসময় শরীরে ব্যাথা হবে ,
  • বমি ভাব থাকবে ,
  • ক্ষুধামন্দা দেখা দিবে ,

কাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি ?

এই রোগটি যেকোনো সময়ে, যেকোনো বয়সের মানুষেরই হতে পারে। তবে এমন কিছু মানুষ আছে যাদের এই রোগটি হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। যেমন –

  • রোগাক্রান্ত মায়ের শিশুরা। 
  • ইনজেকশন দিয়ে যারা মাদক গ্রহণ করেন।
  • আক্রান্তের পরিবারের ঘনিষ্ঠ জনেরা এবং তার স্বামী বা স্ত্রী ।
  • স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত কর্মীরা যারা রক্তের সংস্পর্শে প্রায়শই আসেন, যেমন- শল্য চিকিৎসক, ডায়ালাইসিস ইউনিট ও রক্ত সঞ্চালন বিভাগের কর্মীরা, দাঁতের ডাক্তার, সেবিকা এবং ধাত্রীগণ এনাদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। 

হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধের উপায় 

প্রতিকারের চাইতে প্রতিরোধই উত্তম। হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধ করতে পারলে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা অনেকাংশে কমে যাবে। এই রোগ প্রতিরোধ করতে আপনি যা করতে পারেন- 

  • যৌন মিলনের সময় কনডম ব্যবহার করুন।
  • কাচা সালাদ, ফল-মূল বেশি করে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন ।
  • তেল-চর্বি যুক্ত খাবার পরিহার করুন । 
  • লাল মাংস খাওয়া যাবেনা । 
  • লবণ বা সোডিয়াম সল্ট এড়িয়ে চলুন ।
  • ভিটামিন বি, এন্টি-অক্সিডেন্ট যথা বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ই যুক্ত খাবার বেশি করে খান । 
  • প্রতিদিন অন্তত ৪০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করুন । 
  • ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তুলুন । 
  • দিনে একবেলা ভাত খান , দুই বেলা রুটি খান । 
  • ধূমপান, মদ্যপান কে না বলুন ।
  • অযথা কোন Multivitamin খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। 
  • প্রচুর বিশ্রাম নিবেন । 
  • শৃঙ্খলিত জীবন যাপন করতে হবে ।
  • রক্তের HBsAG পরীক্ষা করে নিন। শুধু আপনি নন , আপনার পরিবারের সদস্যদেরকেও পরীক্ষা করতে বলুন । 
  • হেপাটাইটিস বি এর টিকা নিয়ে না থাকলে  নিয়ে নিন। 
  • আপনার ব্যাক্তিগত জিনিসপত্র আলাদা রাখুন। 
  • একই সিরিঞ্জ এবং সুঁচ বারবার ব্যবহার করবেন না। 
  • নিরাপদ রক্তসঞ্চালন নিচিত করতে হবে। 
  • নিরাপদ এবং সুস্থ  যৌন চর্চা করুন। 

হেপাটাইটিস বি এর চিকিৎসা

হেপাটাইটিস বি এর টিকা নেওয়ার নিয়ম

এই রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে টিকা গ্রহণ। আপনি  যদি এই টিকা গ্রহণ না করে থাকেন ,তাহলে আপনি  যেকোনো সময়ে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। 

টিকা গ্রহণের জন্য প্রথম তিনটি ডোজ এক মাস পর পর নিতে হয়। চতুর্থ ডোজ নিতে হয় প্রথম ডোজের এক বছর পর। পাঁচ বছর পরে আপনি বুস্টার ডোজ নিতে পারবেন। এতে করে আপনার দেহ সহজে এই রোগ প্রতিরোধে সক্ষম হবে। 

হেপাটাইটিস বি রোগ নির্ণয় করা হয় কিভাবে ?

প্রাথমিক ভাবে রক্তে এইচবিএসএজি স্ক্রিনিং টেস্ট করলে এই রোগ সহজে নির্ণয় করা যায়। এর জন্য রোগীর দেহের সামান্য একফোঁটা রক্ত যথেষ্ট। লিভার ফাংশন টেস্টের (এলএফটি) মাধ্যমেও  রোগ নির্ণয় করা সম্ভব।

হেপাটাইটিস বি তে আক্রান্ত হলে কি করতে হবে ?

এই রোগে আক্রান্ত হলে আতঙ্কের কিছু নেই। তবে লিভারের কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা কিংবা ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা সেটি জেনে নেয়াটা দরকার। এর জন্য ডাক্তারের পরামর্শে কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করাতে হবে। টেস্ট রিপোর্ট এবং রোগীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে চিকিৎসার কাজ শুরু করতে হবে। 

এই রোগের জন্য অনেক সময় লিভার সিরোসিস দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে লিভার প্রতিস্থাপন করাতে হবে । 

সবধরনের অর্গানিক ফুড, ২০০+ আয়ুর্বেদ ঔষধ ও খেলার সামগ্রী ঘরে বসেই অর্ডার করুন হেলদি-স্পোর্টস শপ থেকে- https://shop.healthd-sports.com

উপসংহার 

প্রতিবছর ২৮ জুলাই সারা বিশ্বে হেপাটাইটিস বি দিবস পালিত হয়। এই দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই রোগ সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করা। যদি, সঠিক সময়ে যদি সঠিক চিকিৎসা নেয়া যায় তবে এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিকে সুস্থ করা সম্ভব।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top
Scroll to Top