১,২,৩….২৫। ২৫টি বছর, এক ক্লাব, এক ফুটবলার! একটি ক্যারিয়ার। ফ্রান্সিসকো টট্টি। টট্টিকে নিয়ে বলতে গেলে এই আড়াই লাইনই যথেষ্ট।
‘আমার কাছে রোমার হয়ে একটা শিরোপা জেতা মানে জুভেন্টাস অথবা রিয়ালের হয়ে ১০টি শিরোপা জেতার মতোই।’
‘রোমার হয়ে খেলতেই আমার জন্ম এবং রোমার হয়ে খেলেই আমি মরতে চাই।’
রিয়াল মাদ্রিদ কিংবা বার্সার হয়ে মাঠ মাতানো যেকোনো ফুটবলারের স্বপ্ন। কিন্তু কয়জন প্লেয়ার আছেন যারা রিয়াল-বার্সার অফারকে ফিরিয়ে দিতে পারেন! সেই লিস্টে প্রথম যার নাম থাকবে তিনি ফ্রান্সিসকো টট্টি।
অ্যাটাকিং মিডমিল্ডার ফ্রান্সিসকো টট্টির ক্লাব ফুটবলের শুরুটা হয়েছিলো ১৯৮৩-৮৪ মৌসুমে ফরটিটুডো লুডিটুর দিয়ে। এরপর দুইটি মৌসুম কাটিয়েছেন স্মিট ট্রাসটেভারে।
ট্রাসটেভার ছেড়ে ১৯৮৬ সালে নাম লেখেন লোডিজিয়ানি ক্লাবে। সেখানে তিন মৌসুম কাটানোর পর ১৯৯২ সালে যোগ দেন বর্তমান ক্লাব এফসি রোমায়।
১৯৯২ তে রোমায় যোগ দিলেও টট্টির প্রথম গোলটা আসে ১৯৯৪-১৯৯৫ সিজন চলাকালীন সময়ে, সেই সিজনে টট্টি সিরি আ তে ২১ ম্যাচে ৪ গোল করেছিলেন।
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নিজের জাত চেনাতে থাকেন টট্টি। হয়ে উঠেন রোমার মধ্যমাঠের নিউক্লিয়াস। এরই মাঝে ২০০০ ও ২০০৩ সালে নির্বাচিত হন ইতালির সেরা প্লেয়ার।
প্রথমবারের মত কোচ ফ্যাবিও ক্যাপেলোর অধীনে টট্টি জিতেন সিরি আ ট্রফি, ২০০০-২০০১ সিজনে। গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তা সেবার দলের সেরা গোলস্কোরার হলেও টট্টি তার চেয়ে মাত্র ৬ গোল কম করে ১৪ গোল নিয়ে ছিলেন দলের দ্বিতীয় সেরা গোলস্কোরার।
২০০১-২০০২ সিজনেও টট্টি ও রোমা ছিল আপন ছন্দে, ক্যাপেলোর অধীনে সিরি আ তে রানার আপ হলেও জিতে নেয় সুপারকোপা ডি ইতালিয়া।
টট্টি নিজের ছন্দে ছিলেন ২০০৩-২০০৪ সিজনেও। সিরি আ তে সেবার গোল করেন ৩১ ম্যাচে ২০ টি। এসিস্ট একটি।
২০০৬, বিশ্বকাপ। সেবার ছিল তারার মেলা। বেকহ্যাম, জিদান, রোনালদিনহো, কাকা….ছিলেন যুগের অন্যতম সেরা ফুটবলাররা। তবে তাদের মাঝেই আলো কেড়ে নিয়েছিলো একটি দল, ইতালি। টট্টি কি হয়তো সেবার নিজের সেরাটা দেয়ার প্রতিজ্ঞা করে এসেছিলেন। তবে বিশ্বকাপ টট্টিকে দিয়েছে দু হাত ভরেই!
গ্রুপ পর্বে টট্টি করেন দুই এসিস্ট, শেষ ষোলোতে করেন ওই বিশ্বকাপের তার একমাত্র গোল। কোয়ার্টার ফাইনালে আরও অপ্রতিরোধ্য টট্টি, করেন জোড়া এসিস্ট। চতুর্থবারের মত বিশ্বকাপের ওই সোনালি ট্রফিতে চুমু আঁকে ইতালি।
২০০৬-২০০৭ সিজন টট্টির সেরা সিজন। রোমার হয়ে টট্টি হয়ে যান পুরোদস্তুর সেন্টার ফরোয়ার্ড। পজিশন পাল্টে অপ্রতিরোধ্য টট্টি। সিরি আ তে করেন ২৬ গোল, সাথে ৮ এসিস্ট। যা লীগে সর্বোচ্চ। তবে ইতালিয়ান সুপার কাপ ছাড়া জিততে পারেননি কিছুই!
২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে টট্টির জায়গা হয়নি ইতালির স্কোয়াডে, ইতালিও ব্যর্থ হয় গ্রুপ পর্ব পার করতে। ততদিন ইতালিতে টট্টি ব্রাত্য হয়ে পড়লেও রোমাতে ছিলেন সমান উজ্জ্বল।
সাধারণত একজন ফুটবলারের সর্বোচ্চ পারফর্ম করার বয়স ৩৫, কেউ কেউ হয়তো এর ব্যতিক্রম। কিন্তু আক্রমণভাগের বেশিরভাগ ফুটবলারই ৩৫ হতে না হতেই বুটজোড়া তুলে রাখেন, অনেকেই পাড়ি জমান আমেরিকান সকার লীগে। কিন্তু টট্টি সমানতালে খেলে যাচ্ছিলেন রোমার হয়ে। হয়তো একটা সুপ্ত আকাঙ্খা ছিল, শেষবারের মত সিরি আ ট্রফিতে চুমু দেয়ার। কিন্তু জুভেন্টাসের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স টট্টির কেবলই দীর্ঘশ্বাস বাড়াচ্ছিলো।
২০১৫-২০১৬ সিজনের শুরু থেকেই গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিলো, টট্টি অবসর নেবেন। বয়স হতে চলেছিলো ৪০, বুটজোড়া ছাড়ার সময়৷ কিন্তু টট্টি অবসর নেননি৷ সিজনে লীগে ১৩ ম্যাচে ৫ গোল করেন টট্টি।
২০১৬-২০১৭ সিজনের শুরুতেই জানিয়ে দেন টট্টি, ২৫ বছরের ক্লাব ক্যারিয়ারের ইতি টানতে যাচ্ছেন টট্টি। লীগে ১৮ ম্যাচে সাকুল্যে ২ গোল হয়তো টট্টিকে জানান দিচ্ছিলো, এবার বিদায়ের পালা।
জেনোয়ার বিপক্ষে সিজনের শেষ ম্যাচ রোমার, তবে এর চেয়ে বড় কথা রোমার হয়ে টট্টির শেষ ম্যাচ এটি।
টট্টির শেষ ম্যাচকে কেন্দ্র করে পুরো রোমবাসীরা ছিলেন আপ্লুত। স্থানীয় এক পত্রিকা তাদের শিরোনামে টট্টিকে আখ্যায়িত করেন ‘কোর অব দ্য সিটি’ হিসেবে। যার অর্থ হলো ‘শহরের মূল কেন্দ্র’। অথচ এর কিছুই স্পর্শ করেনি রোমার কোচ লুসিয়ানো স্পালেত্তিকে। যে কারণে টট্টিকে তিনি মাঠে নামালেন বিরতির নয় মিনিট পর।
ফুটবলের আরও খবর
স্কোরবোর্ডে তখন ১-১ গোলে সমতা। জয়ের জন্য স্পালেত্তি তাকে পরিয়ে দিলেন সেই বিখ্যাত ১০ নম্বর জার্সিটা। গোল তিনি করতে পারেননি, তবে তার নিজের খেলা ঠিকই খেলেছেন। দলও ম্যাচটি জিতেছে ৩-২ ব্যবধানে। পয়েন্ট তালিকাতে দুয়ে থেকে নিশ্চিত হয়েছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে জায়গা পাওয়াটাও। তবে এবারও সেই আক্ষেপ, হলো না জেতা সেই লীগ ট্রফিটা!
শেষ বাঁশি বাজার সাথে সাথে আর চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি ৪০ বছর বয়সী টট্টি। প্রাণের মাঠ স্টেডিও অলিম্পিয়াকে জানান বিদায়। দর্শকরা এসময় চোখের জল আঁটকে রাখতে পারেননি। ক্লাবের পক্ষ থেকে তার হাতে তুলে দেওয়া হয় তার সেই জনপ্রিয় নাম নম্বর ‘টট্টি ১০’ লেখা বাঁধাই করা একটি স্মারক ফ্রেম। বিদায়বেলা পাশে ছিলেন পরিবার।
লিখিত বিদায়ী বক্তব্যে ইতালিয়ান এই ফুটবলার বলেন, ‘মনে করুন আপনি একজন শিশু এবং ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছেন… এমন সময় আপনার মা এসে ঘুম থেকে ডেকে তুলল স্কুলে যেতে। আপনি এসময় চাইবেন স্বপ্ন দেখাটা চালিয়ে যেতে… আবারো ঘুমিয়ে সেই স্বপ্নের রাজ্যে যেতে চেষ্টা করবেন কিন্তু পারবেন না।’ আবেগমাখা কন্ঠে টট্টি বলেন, ‘এখন এটা স্বপ্ন নয়, সত্যি। এবং আর আমি এখন ঘুমোতে পারব না।’
যার মধ্য দিয়ে শেষ হয় রোমায় টট্টির যুগের সমাপ্তি। পরিসংখ্যানের দিক তাকালে টট্টির ক্যারিয়ার অতটা উজ্জ্বল নয়, কিন্তু টট্টিদের পরিসংখ্যান দিয়ে বিচার করা যায় না। রোমার হয়ে ৭৮৫ ম্যাচে ৩০৭ গোল ও ১৮৬ এসিস্ট অবশ্যই অন্যরকম কিছু। সারাজীবন একটি ক্লাবের ভালোবাসায় সেই ক্লাবেই অবস্থান করা, যা পরিসংখ্যানের চেয়েও দামি! টট্টিদের জন্যই হয়তো ফুটবলটা আরও সুন্দর!
সবধরনের অর্গানিক ফুড, ২০০+ আয়ুর্বেদ ঔষধ ও খেলার সামগ্রী ঘরে বসেই অর্ডার করুন আমাদের শপ থেকে- https://shop.healthd-sports.com