জিয়ানলুইজি বুফন, একটা নাম, একটা ব্র্যান্ড। তার নাম শুনলেই একটা কথা সর্বপ্রথম মাথায় আসে, সর্বসেরা! সর্বকালের সেরা গোলরক্ষক কে, লেভ ইয়াসীন? অলিভার কান? নাকি হালের ম্যানুয়াল ন্যুয়ার….এই নামগুলোর সাথে সমানভাবে উচ্চারিত হয় একটি নাম, জিয়ানলুইজি বুফন।
বুফনের জন্ম হয়েছিলো অ্যাথলেট পরিবারে। মা ছিলেন তিনবারের সেরা ইতালিয়ান চাকতি নিক্ষেপকারী। বাবাও ছিলেন অ্যাথলেট। দুই বোনের দু’জনই ভলিবল খেলতেন ইতালির হয়ে। বুফনও যে জীবনটা স্টেডিয়ামেই গড়বেন সেটা অনুমেয় ছিল। ১০ বছরের ছোট্ট সেই বুফনকে ১৯৮৮ সালে তাই ভর্তি করিয়ে দেয়া হল ফুটবল একাডেমিতে। গোলকিপার হিসেবে নয়, বুফন খেলা শুরু করলেন মিডফিল্ডার হিসেবে।
১৯৯০ এর বিশ্বকাপে(সেবার ইতালি ছিল স্বাগতিক) বুফন সেনেগালের গোলরক্ষক থমাস এনকোনোর খেলা দেখে মুগ্ধ হন। বেছে নেন আইডল হিসেবে। তখন কে ভেবেছিলো বুফন তার আইডলকে ছাড়িয়ে চলে যাবে অনন্য উচ্চতায়?
জুভেন্টাস-বুফন, সমার্থক শব্দ? ব্যাকরণগত দিক দিয়ে অবশ্যই নয়, তবে ফুটবলীয় দিক দিয়ে সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে নিঃসন্দেহে! তবে বুফন কিন্তু ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ‘পার্মা’ তে। ১৯৯৫ হতে ২০০১ পর্যন্ত কাটিয়েছেন পার্মায়। তারপর যোগ দিন জুভেন্টাসে। জুভেন্টাসের তখনকার নিয়মিত কিংবদন্তী গোলরক্ষক এডউইন ভ্যান ডার সার জুভেন্টাস ছেড়ে পাড়ি জমান ফুলহ্যামে।
ফলে ফাঁকা হয়ে যায় গোলরক্ষকের পজিশন। বুফন এর পারফরম্যান্স দেখে জুভেন্টাসের ম্যানেজমেন্ট দ্বিতীয় কিছু ভাবে নি। গোলকিপারের বদলের বিশ্বরেকর্ড গড়ে জিজি আসেন জুভেন্টাসের শিবিরে।
Table of Contents
জিয়ানলুইজি বুফন
জুভেন্টাস যে বিশ্বরেকর্ড ট্রান্সফারে বুফনকে এনে ভুল করেনি সেটা বুফন দেখাচ্ছিলেন মাঠে। এরই মাঝে টানা সিরি আ জিততে থাকে জুভেন্টাস। তখনকার সিরি আ আর এখনকার সিরি আ এর মাঝে বিস্তর তফাৎ। এরই মাঝে চলে আসে ২০০৬ এর বিশ্বকাপ। যা বুফনকে নিয়ে যায় এক অননু উচ্চতায়। কতটা উচ্চতায় সেটা বোধহয় বুফন নিজেও জানেন না।
২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনাল। অতিরিক্ত সময়ের প্রথম ১৫ মিনিটও প্রায় শেষের দিকে। স্বাগতিক জার্মানির রাজধানী বার্লিনের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ফাইনাল ম্যাচ। হঠাৎই ডান প্রান্ত থেকে সানিওলের ক্রসে জিদানের হেড! ইতালির কোটি মানুষ হয়তো নিমিষেই চোখ বুজে ফেলেছিলেন, সেকেন্ডের ভগ্নাংশের সমান মুহূর্ত। বিশ্বের কোটি মানুষের চোখ তখন বাতাসে ভাসতে ভাসতে গোলবারের দিকে যাওয়া ‘টিমজিস্ট’ নামের ওই চামড়ার বলের ওপর। বুফন শুণ্যে উড়াল দিলেন। এক হাতের তালু দিয়ে দিক বদলে দেন বলটার। মাটিতে ফেরত আসার আগেই জিদানের সাথে মাথায় হাত পড়ে প্যারিস, মার্সেই সহ ফ্রান্সের প্রতিটি অলি-গলির কোটি মানুষেরও।অন্যদিকে রোম প্রাণ ফিরে পায়।
একটা সেকেন্ড, সহজেই ভুলে যাওয়া যায়। এই ক্ষুদ্র একটা মুহুর্তের ইতিহাস হয়ে থাকার সাধ্য নেই। ফাইনালে ফ্রান্সকে হারিয়ে ২০০৬ বিশ্বকাপ জয়টা তো এর চেয়ে অনেক গুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে ওই দল আর ট্রফিটা। সাথে আলাদা করে একজন। সেই নাম, সেই ব্র্যান্ড,
জিয়ানলুইজি বুফন! সময় যখন খলনায়ক!
বিশ্বকাপ ২০০৬ জয়ের দিনই জানা হয়েছিল পাতানো ম্যাচ খেলার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় জুভেন্টাসকে নেমে যেতে হবে ইতালিয়ান ফুটবলের প্রথম স্থান থেকে। এই খবরের পর তুরিনের ক্লাব ছেড়ে দিয়ে একে একে অন্য ক্লাবে চলে যান সুইডিশ সুপারস্টার জালাতান ইব্রাহিমোভিচ, ক্যানাভারো, এমারসনরা । জিয়ানলুইজি বুফনের বয়স তখন ২৮। ক্যারিয়ারের চূড়ায় ছিলেন বলা চলে ওই সময়ে, সদ্য জিতেছেন আরাধ্য বিশ্বকাপ। আর গোলকিপারদের তো বয়সের শুরুই হয় ওখান থেকে।
আলেসান্দ্রো দেল পিয়েরোর ‘আ ট্রু জেন্টালম্যান নেভার লিভস হিজ লেডি’ কথার সাথে গলা মেলালেন বুফনও। সদ্যই বিশ্বকাপ জিতে এসে ইতালির দ্বিতীয়স্তরের দলের বিপক্ষে মাঠে নামলেন জুভেন্টাসের জার্সি গায়ে চড়িয়েই। টাকা-পয়সা, খ্যাতি, ক্যারিয়ার, বড় ক্লাবের হাতছানি সব অবজ্ঞা করে।
একেই কি বলে প্যাশন? ভালোবাসা? নাকি এর নামই ফুটবল?
জুভেন্টাসকে নিয়ে পরের মৌসুমেই সিরি আ তে ফেরত আসলেন বুফন। সেবারও ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবল ম্যাচ ছাড়াই কাটল বিশ্বকাপজয়ী গোলকিপারের। এক বছর পর ফুরোল সেই অপেক্ষাও।
শুরুর কয়েক বছর সুবিধা করতে না পারলেও সময়ের সাথেই বুফনের জুভেন্টাস ফিরেছে সেই পুরনো রূপে। ফিরেছেন ভয়ংকর রুপেই।
তবে আক্ষেপ একটা থেকেই গেল। দুনিয়ার সব শিরোপাই ধরা দিয়েছে বুফনের কাছে, এক চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপাটাই ধরে দেখা হয়নি। অথচ কতবার চ্যাম্পিয়ন্স লাগে গের ফাইনাল খেলা হল? ২০০৩ এ এসি মিলানের কাছে, ২০১৫ তে বার্সার কাছে, ২০১৭ তে উড়তে থাকা রিয়ালের কাছে, যে ম্যাচে রোনালদো করেছিলেন সেই দুর্দান্ত বাইসাইকেল গোলটি।
বুফনের ব্যর্থতা নাকি চ্যাম্পিয়নস লিগের অপূর্ণতা?
১৭ বছর পর বুফন জুভেন্টাস ছাড়লেন, ছাড়লেন তুরিনের ওল্ড লেডিদের। ফ্রি ট্রান্সফারে যোগ দিলেন পিএসজি তে। কাঁদলেন, সবাইকে কাঁদালেন। সেদিন কি ফুটবল ও কেঁদেছিলো?
পিএসজিতে এক সিজন কাটিয়ে ২৫ ম্যাচে ৯ ক্লিনশিট রেখে ২০১৯ এ আবারও জুভেন্টাসে যোগ দেন বুফন। বয়স তখন তার ৪১। কিন্তু যার নাম বুফন তাকে বয়স কিভাবে থামাবে? এই সিজনেও ১৫ ম্যাচে ৫টি ক্লিনশিট রাখলেন, গোল হজম করলেন সাকুল্যে ১২ টি। কিন্তু সর্বকালের অন্যতম সেরা তারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে সাইন করিয়েও বুফনের ধরা হলো না অরাধ্য সেই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি!
২০২০/২০২১ সিজনেও জুভেন্টাস পারলো না চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জিততে। এই সিজনেও বুফন ১৪ ম্যাচে ৬ টি ক্লিনশিট রাখলেন। সিজন শেষে যোগ দিলেন তার সাবেক ক্লাব পার্মায়।
- চলতি সিজনে পার্মা ১৮ ম্যাচে ২৩ পয়েন্ট নিয়ে ১২ তম অবস্থানে আছে সিরি বি লীগে।
- জুভেন্টাসের হয়ে বুফন খেলেছেন ৬৮৫ ম্যাচ, ক্লিন শিট রেখেছেন ৩২২ টি ম্যাচে। যা সর্বোচ্চ।
- ক্লাব ক্যারিয়ারে ৯৪৮ ম্যাচে বুফন রেখেছেন ৪২২ টি ক্লিনশিট!
- চ্যাম্পিয়নস লীগেও অদম্য বুফন। ১২৪ ম্যাচে ক্লিনশিট ৫৩ টিতে!
- ইতালির হয়ে বুফন খেলেছেন ১৭৬ টি ম্যাচ! যা ইতালির মত দলের জন্য অবিশ্বাস্য!
- হয়তো আরো একটি বিশ্বকাপ খেলতেন, বাদ সাধলো ইতালি নিজেই! ২০১৮ বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে পারেনি তারা।
বুফন কি অবসর নেবেন? নাকি ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ খেলবেন? বুফনরা কেমন পারফর্ম করেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন অবান্তর, বয়স নিছকই সংখ্যা। ফুটবল চায় বুফন আরও খেলুক, এটাই ফুটবল।
বুফন কি শুনতে পাচ্ছেন?
সবধরনের অর্গানিক ফুড, ২০০+ আয়ুর্বেদ ঔষধ ও খেলার সামগ্রী ঘরে বসেই অর্ডার করুন আমাদের শপ থেকে- https://shop.healthd-sports.com