মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধির ঘরোয়া চিকিৎসা

মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধি হলে যা করবেন । ২২ উপায়ে সমাধান নিন!

পায়ুপথ যদি কোনো কারণে ফুলে যায় তবে একে মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধি বলে। মূলত এটিই চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় পাইলস বা অর্শ নামে পরিচিত। 

মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধি সমস্যায় ভুগছেন এমন মানুষের সংখ্যা নেহাতই কম নয়। দিনদিন এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে কম বয়সীদের মাঝেও এই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এছাড়াও পরিবারের কারো যদি এই সমস্যা থাকে, তবে পরবর্তী প্রজন্মেও রোগটি স্থানান্তরিত হতে পারে। 

মূলত অনিয়মিত জীবনযাপনই এর কারণ। তাই এখনই প্রয়োজন সচেতনতা। আপনাদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আজকের আর্টিকেলে আমরা এ সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো। 

মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধি 

বিশেষজ্ঞদের মতে, পায়ুদ্বারের ভেতরে অনেকগুলো শিরা থাকে। কোন কারণে সেই শিরাগুলো ফুলে বা শক্ত হয়ে গেলে যে সমস্যার সৃষ্টি হয় তাকে মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধি বলে। 

পায়ুপথে যেন কোন রোগ জীবাণু প্রবেশ করতে না পারে এজন্য মুখ বন্ধ থাকে। মুখ বন্ধ রাখার জন্য বেশ কিছু শিরাকে একসাথে কাজ করতে হয়। তার মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হলো অ্যানাল কুশন। এই কুশনগুলো ৩ দিক থেকে চাপ দিয়ে পায়ুপথের মুখ বন্ধ রাখতে সাহায্য করে।

যদি কোনো কারণে কুশনগুলো ফুলে যায়, শক্ত হয়ে যায়, বা নিচের দিকে নেমে আসে, অথবা গোটার মত দেখা যায়, তখন তাকে মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধি বা পাইলস বলে। 

মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধি হলে সরাসরি তা বোঝা যায় না কিন্তু কিছু লক্ষণ দেখা যায়। লক্ষণগুলোর মাধ্যমে বোঝা যায় মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধি হয়েছে। আসুন জেনে নিই সেই লক্ষণগুলো কী কী। 

মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধি হলে তার আনুষঙ্গিক লক্ষণ 

পাইলস যেহেতু পায়ুপথে হয়ে থাকে তাই বাহিরে থেকে এটি বোঝা যায় না। অনেকসময় এর কোনো ব্যথা বা অস্বস্তিও থাকে না। তাই আমাদের মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধি পেলে কি কি লক্ষণ দেখা দিতে পারে সে ব্যাপারে আগাম জেনে রাখা উচিত। তাহলে আসুন জেনে নিই লক্ষণগুলো-

১. পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া

মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধি পেলে পায়খানার সাথে উজ্জ্বল লাল বর্ণের রক্ত বের হয়। সাধারণত পায়খানার পরে টয়লেট পেপার ব্যবহার করলে সেখানে রক্ত লেগে থাকতে দেখা যায়। অথবা কমোডে বা প্যানের গায়ে টকটকে রক্তের লাল ছোপ দেখা যেতে পারে।

মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধি পেলে পায়ুপথের মুখে থাকা অ্যানাল কুশনগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হয়। এই রক্ত বেরিয়ে জমাট বাধার সুযোগ পায় না। যার কারণে রক্তগুলো পায়খানার সাথে বের হয়ে আসে। 

[বিঃ দ্রঃ যদি কোনো কারণে পায়খানার সাথে গাঢ় খয়েরী রঙের রক্ত যায়, বা আলকাতরার মতো কালো ও নরম পায়খানা হয় তবে সেটা মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধি জন্য নয়। পরিপাকতন্ত্রের কোনো অংশে রক্তপাতের কারণে পায়খানার সাথে এমন রক্ত যেতে পারে। এমন রক্তপাতের দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।]

২. পায়ুপথের মুখের অংশগুলো বেরিয়ে আসা

মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধি পেলে মলত্যাগের সময় অ্যানাল কুশনগুলো নরম গোটার মতো বের হয়ে আসে। এগুলো মালত্যাগের পর নিজে নিজেই ভেতরে ঢুকে যায়। আবার কিছু ক্ষেত্রে এগুলো আঙ্গুল দিয়ে ভেতরে ঢোকানোর প্রয়োজন হতে পারে।

মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধি হওয়ার সাথে সাথে এই বাড়ন্ত অংশটি বাড়তে বাড়তে আঙুলের মত বড় হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে অ্যানাল কুশন এত বড় হয়ে যায় যে আর ভেতরে যাবার অবস্থায় থাকে না। 

৩. পায়খানার রাস্তায় ব্যথা হওয়া

মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধি পেলে তীব্র ব্যথা হয় না। তবে যদি অ্যানাল কুশন সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায় তবে তীক্ষ্ণ বা তীব্র ব্যথা হতে পারে। কুশনগুলোতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে এই ব্যথার সৃষ্টি করে। 

৪. পায়খানার রাস্তায় চুলকানি

মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধি হলে কখনো কখনো পায়ুপথে বা এর মুখের আশেপাশে চুলকানি হতে পারে। এছাড়া পায়ুপথ দিয়ে মিউকাস বা শ্লেষ্মা-জাতীয় পিচ্ছিল ও আঠালো পদার্থ বের হতে পারে। অনেক সময় মলত্যাগের সময়ও চুলকাতে পারে। 

এছাড়াও মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধি পেলে রোগীর মাঝে আরো বেশি কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যেমন-

  • কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া জাতীয় সমস্যা।
  • মলদ্বার দিয়ে রস নির্গত হওয়া বা ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়তে থাকা।
  • বমিবমি ভাব বা বমি হওয়া।
  • রক্ত শূন্যতায় ভোগা।
  • অস্থিরতায় ভোগা।
  • একটানা অনেকক্ষণ বসে বা দাঁড়িয়ে থাকলে পায়ুপথে ব্যথা করা। 
  • মলত্যাগের চাপ থাকার পরও ঠিকমতো মল বের না হওয়া।

মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধির ঘরোয়া চিকিৎসা

আমাদের জীবন যাপন এবং খাদ্য গ্রহণ নিয়ম মাফিক করতে পারলে এ সমস্যা থেকে দূরে থাকা সম্ভব। পাইলস এর চিকিৎসার জন্য সবার আগে পাইলস হওয়ার কারণগুলো প্রতিরোধ করতে হবে। তাই আসুন জেনে নিই মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধি রোধের ঘরোয়া চিকিৎসা –

  • সবার আগে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে দূরে থাকতে হবে। এজন্য বেশি বেশি আঁশ বা ফাইবারযুক্ত জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। যেমন- শাকসবজি, ফলমূল, ডাল, লাল চাল ও লাল আটার তৈরি খাবার। সেই সাথে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। 
  • ফাইবার পানি শোষণ করার মাধ্যমে পায়খানা নরম করে। ফাইবার যেন ঠিকমতো কাজ করতে পারে এজন্য  সারাদিনে অন্তত দুই লিটার পানি পান করতে হবে। 
  • মলত্যাগের সময় জোরে চাপ দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। মলত্যাগের সময় চাপ দিলে অ্যানাল কুশনে চাপ পরে। পায়খানা যেন নরম হয় এবং সহজেই মলত্যাগ করা যায়, সেভাবে জীবনযাপন করতে হবে।
  • মলত্যাগের সময় অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা যাবে না। টয়লেটে বসে ম্যাগাজিন, পেপার, মোবাইল-এসবে মনোনিবেশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • মলত্যাগের চাপ আসলে তা আটকে রাখা অনুচিত। এতে পায়খানা শক্ত হয়ে যায়। যা পরবর্তী মলত্যাগের সময় অ্যানাল কুশনে চাপ সৃষ্টি করে। তাই চাপ আসলে দেরি না করে বাথরুমে চলে যেতে হবে।
  • নিয়মিত ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করতে হবে। ব্যায়ামের জন্য ভারী ব্যায়াম বেছে নিতে হবে, তা কিন্তু নয়। শরীরকে চলমান রাখতে হাঁটাচলা, হালকা স্ট্রেচিং, ও যোগব্যায়াম করা যেতে পারে।
  • ওজন অতিরিক্ত হলে তা কমিয়ে ফেলতে হবে। ওজন যতবেশি হবে, মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধির সম্ভাবনা তত বেশি বাড়ে। তাই পাইলস এর রোগীদের ওজন কমানোর পরামর্শ দেয়া হয়। 

মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধির অপারেশন

ঘরোয়া চিকিৎসা এবং ডাক্তারের উপদেশ পরামর্শগুলো সঠিকভাবে মেনে চলার পরেও যদি এই রোগের এর সমাধান না হয়, সেক্ষেত্রে অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে। অনেকেই পাইলসের অপারেশন নিয়ে চিন্তায় থাকেন কিন্ত এটি নিয়ে চিন্তার আসলে কিছু নেই। এটি একটি ছোট্ট অপারেশন যা চিরতরে আপনাকে পাইলস থেকে মুক্তি দিতে পারে।

চিকিৎসকগণ সাধারণত ৩ ধরনের অপারেশন করে থাকেন—

১. হেমোরয়েডেকটোমি

এই অপারেশনের মাধ্যমে মাংস বৃদ্ধির ফলে যে গোটাগুলো বের হয় সেগুলো কেটে অপসারণ করা হয়। 

২. স্টেপলড হেমোরয়েডোপেক্সি

এই পদ্ধতির মাধ্যমে সার্জারি করে মাংস বৃদ্ধির গোটাগুলো পুনরায় পায়ুপথের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।

৩. হেমোরয়েডাল আর্টারি লাইগেশন

এক্ষেত্রে মাংস বৃদ্ধির ফলে যে গোটাগুলো বের হয় সেগুলোতে রক্ত সরবরাহ অপারেশনের মাধ্যমে বন্ধ করে দেয়া হয়। 

এসব অপারেশনের জন্য সাধারণত চেতনানাশক ব্যবহার করে রোগীকে অজ্ঞান করে অপারেশন করা হয়৷ এবং অপারেশনের পর রোগীকে দুই-একদিন হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন হতে পারে।

উপসংহার

আমাদের সমাজে অসংখ্য রোগী মলদ্বারে মাংস বৃদ্ধি সমস্যায় ভুগে থাকেন। কিন্তু অনেকেই লজ্জাবশত কারণে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন না। যা রোগীর অবস্থাকে আরো জটিল করে তোলে। তখন অপারেশনের বিকল্প কিছু থাকে না। 

এমনকি এতে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুও হতে পারে। 

তবে একটু সচেতন হলেই মলদ্বারের মাংস বৃদ্ধি হওয়ার সমস্যা থেকে মুক্তি সম্ভব। তাই আমাদের এখনই উচিত এই ব্যাপারে সর্তক হওয়া।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top
Scroll to Top